uncategory

মুখ থুবড়ে পড়েছে ডেমু ট্রেন

DEMU Train 02
ঢাকা জার্নালঃ  উদ্বোধনের দুই সপ্তাহের মধ্যেই বিবর্ণ হয়ে পড়েছে ডেমু ট্রেন। যাত্রীসেবা ও রেলওয়েকে স্বস্তি প্রদান— কোনো লক্ষ্যই পূরণ করতে পারছে না। গত ২৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘটা করে উদ্বোধন করলেও পরদিনই তা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ওয়ার্কশপ থেকে ফেরত আসার পর আগের সময়সূচি অনুযায়ী ট্রেন চালু হলেও পর্যাপ্ত বাতাসের অভাব ও গরমে যাত্রীরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর সেবা সচল রাখতে আগের সময়সূচি পাল্টে অফপিক ও সুপার অফপিক আওয়ারে আবার তা চালু করা হয় ৩০ এপ্রিল। নতুন এ সময়সূচি একদিকে যাত্রীদের যেমন কাজে লাগছে না, অন্যদিকে বাড়ছে রেলওয়ের লোকসানও।
রেলওয়ের অপারেশন বিভাগের আপত্তি সত্ত্বেও ৬৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে নিম্নমানের এ কমিউটার ট্রেন কেনা হয় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের ব্যক্তিগত আগ্রহে। ব্যয়বহুল এ ডেমু ট্রেনের জ্বালানি খরচ তুলনামূলক বেশি। এখন আবার যাত্রী পরিবহন কম হওয়ায় এতে লোকসান আরো বাড়বে। ফলে এ ট্রেন পরিচালনায় রেলওয়ে সব দিক থেকেই ক্ষতির সম্মুখীন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ প্রকল্পের ৬৬২ কোটি টাকাই অপচয় হচ্ছে।
চীন থেকে আনা দুই সেট (প্রতি সেটে তিন ইউনিট) কমিউটার ট্রেন এখন দিনে তিনবার ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচল করছে। সকাল ৫টা ৪০ মিনিট ও রাত ১০টায় ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া এ ট্রেনে যাত্রী উঠছেন ১০০-১৫০ জন। আর বেলা ১টা ৪০ মিনিটের ট্রিপে যাত্রী পরিবহন হচ্ছে সর্বোচ্চ ৩০০ জন। অথচ এর যাত্রী ধারণক্ষমতা ৬০০ জন। চলাচলের সময়সূচি হিসেবে অফপিক ও সুপার অফপিককে বেছে নেয়ায় যাত্রী কমে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
যাত্রী কমে যাওয়া প্রসঙ্গে রেলওয়ের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবু তাহের বণিক বার্তাকে বলেন, ট্রেনটি চালুর পর অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় পরদিনই তা বন্ধ করে দেয়া হয়। ৩০ এপ্রিল আবার ট্রেনটি চালু হয়। এক্ষেত্রে যাত্রীর চাপ সামলাতে ডেমু ট্রেন অফপিক সময়ে চালানো ছাড়া বিকল্প নেই। তাই সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে সময়সূচি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখন আর কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
তবে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) শাহ জহিরুল ইসলাম জানান, মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) অফপিক ও সুপার অফপিক সময়ে এ ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। সে অনুযায়ী ডেমু ট্রেন চলছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে রেলওয়ের ক্ষতির কথা বিবেচনা করে আগেই এ ট্রেন কেনার বিপক্ষে মতামত দিয়েছিল অপারেশন বিভাগ। এ প্রকল্পে যে অর্থ ব্যয় হয়েছে, তাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে নতুন ১০-১২টি ট্রেন চালু করা যেত।
রেলওয়ের তথ্যমতে, চীন থেকে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনায় ব্যয় হচ্ছে ৬৬২ কোটি টাকা। অথচ এ অর্থে ১০টি ইঞ্জিন ও ১২০টি কোচ কেনা সম্ভব; যাতে এতে নতুন ১০টি ট্রেন পরিচালনা করা যায়। এছাড়া ডেমু ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগি সাধারণ ট্রেনের তুলনায় অনেক হালকা ও কম টেকসই। ট্রেনগুলোয় টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকায় দূরপথে ভ্রমণ করতে গিয়েও যাত্রীরা সমস্যায় পড়বে।
এদিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে আরো দুই সেট, ঢাকা-জয়দেবপুর রুটে দুই সেট ও চট্টগ্রামের সার্কুলার রুটে দুই সেট ডেমু ট্রেন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রেলওয়ে। কিন্তু ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে প্রথম দুই সেটের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে এখনো তা কার্যকর করা হয়নি। ফলে পরীক্ষামূলক পরিচালনা শেষে ট্রেনগুলো বসিয়ে রাখা হয়েছে। দেশে আসার পর বাকি ১২ সেট ট্রেন পর্যায়ক্রমে আরো ছয়টি রুটে চালুর পরিকল্পনা আছে। কিন্তু এ ট্রেনের বিভিন্ন অসুবিধার কারণে তা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে রেলওয়ে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের এক কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরত্বেই যাত্রীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ৪০-৫০ কিলোমিটার দূরত্বের রুটে চলাচল করলে যাত্রীদের শারীরিক অবস্থা কী হবে, সে দুশ্চিন্তায় নতুন ট্রেন নামানোর সাহস পাচ্ছে না রেলওয়ে। প্রকল্পটি এখন রেলের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডেমু ট্রেনের ভাড়া ও ডিজাইন নিয়েও অসন্তুষ্ট যাত্রীরা। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলমান সাধারণ ট্রেনে ভাড়া নেয়া হয় ১০ টাকা। কিন্তু ডেমু ট্রেনে নেয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। যাত্রীদের অভিযোগ, এসির মডেলে তৈরি এ ট্রেন নন-এসি। জানালা অনেক ছোট। দরজাও বন্ধ থাকে। ফলে ট্রেনের ভেতর বাতাস প্রবেশের সুযোগ কম। বগির ছাদে স্থাপিত ছোট বক্স ফ্যানগুলোর গতিও কম। আবার এ ট্রেনে যাত্রীদের মাথার মাত্র ছয় ইঞ্চি ওপরে ছাদ। আর বগির নিচে ইঞ্জিন থাকায় যাত্রাপথে ট্রেনের ভেতরটা দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এতে ট্রেন চলার সময় অস্বাভাবিক গরম অনুভূত হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ডেমু ট্রেনের ত্রুটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েও বিপাকে পড়ে চীনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তানসাং ভেহিক্যাল কোম্পানি ও বাংলাদেশ রেলওয়ের কারিগরি দল। গরম থেকে নিষ্কৃতি পেতে প্রাথমিকভাবে সব জানালা খুলে ফেলা হয়। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টিতে যাত্রীরা ভিজে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়ায় আবারো তা লাগানো হয়।
অথচ চীন থেকে দেশে আনার পর ট্রেনগুলো দেড় মাস পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হয়। এছাড়া কারিগরি বিভিন্ন দিক যাচাই করতে প্রকল্প পরিচালকসহ রেলওয়ে মেকানিক্যাল বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একাধিকবার চীন ভ্রমণ করেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মোহাম্মদ শাহজাহান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা কম হওয়ায় এ ট্রেনগুলো ভালো সেবা দিচ্ছে। তবে আমাদের দেশে এত কম ধারণক্ষমতার ট্রেন দিয়ে এত বেশি মানুষের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। আবার ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করাও সম্ভব নয়। তাই রেলওয়ের অপারেশন বিভাগ এ ধরনের ট্রেন কেনার বিরোধিতা করেছিল।’

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.