Leadসংবাদ শিরোনামসব সংবাদ

মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের স্বীকারোক্তি

19শেষ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতারা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়া শুরু করলেন। একসময় যাঁরা স্বীকার করেননি বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী আছে, একাত্তরে কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত জড়িত ছিল, তাঁরাই এখন ফাঁসির হাত থেকে রক্ষা পেতে ক্ষমা চাচ্ছেন। এই ক্ষমা চাওয়া একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের স্বীকারোক্তি বলেই মনে করেন আইনজ্ঞরা।

ফাঁসির দণ্ড থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার আগ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চান। সর্বশেষ জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের  দেওয়া ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে করা আপিল শুনানিতেও তাঁর আইনজীবী মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের কাছে অনুকম্পা প্রার্থনা করেন।

বিশিষ্ট আইনজীবীরা বলেন, এটি অবশ্যই এক ধরনের ক্ষমা প্রার্থনা; মৃত্যুদণ্ড যাতে দেওয়া না হয় সে জন্য ক্ষমা চাওয়া। শুধু তাই-ই নয়, নিজামীর মামলা শুনানি করতে গিয়ে তাঁর আইনজীবী একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা ছিল বাংলাদেশবিরোধী, এটাও স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন শুনানিকালে একপর্যায়ে বলেন, জামায়াতে ইসলামী এবং জামায়াতে ইসলামীর সদস্য হিসেবে তাঁরা তত্কালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিশ্বাস করতেন। সেই বিশ্বাস থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর যাঁরা এখানে ছিলেন তাঁদেরকে তাঁরা মরাল সাপোর্ট দিয়েছেন; রাজনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়েছেন।

শুনানিতে তিনি এ-ও বলেন, ওই সময় (একাত্তর সালে) অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এটা সত্য। এসব বক্তব্য এবং কৌশলে এমন ক্ষমা চাওয়ার ঘটনা জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ ও স্বীকারোক্তি বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। জামায়াত নেতা মুজাহিদ ও বিএনপি নেতা সাকা চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে দুজনই সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানান। তাঁদের আবেদনে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ ছিল।

আর এই অনুচ্ছেদ উল্লেখ করা অর্থই ক্ষমা প্রার্থনা করা। বিলম্বে হলেও জামায়াত নেতা মুজাহিদের ক্ষমা চাওয়ায় এটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, একাত্তরে জামায়াত দলীয়ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল। আর এই বিরুদ্ধে থাকতে গিয়ে তাঁরা পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করে; মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ করে। নিজামীর মামলা শুনানি করতে গিয়ে তাঁর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন (তিনি শুধু নিজামীর আইনজীবী নন, জামায়াতের সব শীর্ষস্থানীয় নেতার মামলা পরিচালনা করেছেন তিনি) বিচারকদের উদ্দেশ করে বলেছেন, আপনারা যদি মনে করেন নিজামীর কিছু কিছু অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে তবে তাঁকে যেন সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া না হয়।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিজামীর আইনজীবী আদালতকে বলেছেন, নিজামীর অপরাধ প্রমাণ হলেও যেন বয়স বিবেচনায় বা তাঁর ভালো ব্যবহার বিবেচনায় তাঁর সাজা কমিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে নিজামী যে অপরাধ করেছেন তা পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।’ এই প্রথম জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের পক্ষে শুনানি করতে গিয়ে কোনো আইনজীবী প্রাণভিক্ষা চাইলেন বলেও অ্যাটর্নি জেনারেল দাবি করেন। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আবদুল কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মামলার যুক্তিতর্ক পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রত্যেকের আপিল শুনানিতে আসামিদের খালাস চাওয়া হয়েছে, সাজা কমানোর দাবি কখনো করা হয়নি। শুনানির সময় সর্বোচ্চ আদালতও মন্তব্য করেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে জামায়াত ও তাদের সহযোগী সংগঠন আলবদর, রাজাকার, আলশামস বাহিনী পথ দেখিয়ে দিয়েছে। আর রাষ্ট্রপক্ষ সব সময়ই একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকার কথা জোর দিয়েই বলে আসছে। মামলাগুলোর সাক্ষ্য-প্রমাণ, রায় সব কিছু আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছে যে জামায়াতে ইসলামী মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল।

সর্বশেষ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ক্ষমা চাওয়া জামায়াতের ভূমিকা আরো স্পষ্ট করে দেয়। যদিও খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা দোষ স্বীকার নয়। দোষ স্বীকার করার প্রশ্নই আসে না। আমি বলেছি, অনেকগুলো অভিযোগের কোনোটিতে যদি মনে হয় অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে সেই ক্ষেত্রে আসামির বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনায় লঘুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য তিনি।’ আইনজ্ঞরা মনে করেন, জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতার প্রধান আইনজীবীর এ ধরনের বক্তব্য সর্বোচ্চ আদালতে দেওয়ায় এটা প্রতিষ্ঠিত হলো যে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশবিরোধী ছিল; জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। একাত্তরে পাকিস্তানকে জামায়াত নৈতিক সমর্থন দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে তা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেওয়া তাদের রাজনৈতিক পরাজয়। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল বাসেত মজুমদার  বলেন, কারো মৃত্যুদণ্ড হলে আপিলের শুনানির সময় মৃত্যুদণ্ড মওকুফের আবেদন জানাতে পারে। তবে আদালতের আদেশ মেনে নিয়েই এ আবেদন জানাতে হয়। এর অর্থই হচ্ছে দোষ স্বীকার করে নেওয়া। কাজেই  নিজামী-মুজাহিদ গং দোষ স্বীকার করে নিয়েই মৃত্যুদণ্ড মওকুফ চেয়েছেন। এর মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের অপরাধ স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় এবং প্রকারান্তরে এটা জামায়াতের মানবতাবিরোধী অপরাধের স্বীকারোক্তি।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক বিশিষ্ট আইনজীবী শ ম রেজাউল করিম বলেন, সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণদণ্ড রহিত করার জন্য মুজাহিদের আবেদন এবং আপিল বিভাগে নিজামীর প্রাণদণ্ড থেকে সাজা কমানোর জন্য তাঁর আইনজীবীর অনুকম্পা প্রার্থনা প্রমাণ করে তাঁরা যুদ্ধাপরাধী ছিলেন। জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের আবেদন প্রমাণ করে একাত্তরে তাঁদের ভূমিকা ছিল মানবতাবিরোধী। সর্বোচ্চ আদালতের বিভিন্ন রায়ই প্রমাণ করেছে জামায়াত যুদ্ধাপরাধী দল। তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের স্বীকারোক্তি সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে পাকাপোক্ত করেছে। এটা জামায়াতের রাজনৈতিক পরাজয় ছাড়া অন্য কিছু নয়।  অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম  বলেন, জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মামলায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতে তাঁর আইনজীবী স্বীকার করেছেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় জামায়াত পাকিস্তানকে নৈতিক সমর্থন দিয়েছে; তাদের সহযোগিতা করেছে; অপরাধ করেছে। এই স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে প্রমাণ হলো, জামায়াত দাবি করে আসছিল তারা যুদ্ধাপরাধী দল নয়, তা অসত্য।

এমনকি জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ ও অন্য একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতা সাকা চৌধুরী রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমার আবেদন করেছিলেন। এতেই প্রমাণিত হয় তাঁরা যুদ্ধাপরাধী। এই ক্ষমার আবেদন ও সর্বোচ্চ আদালতে প্রাণদণ্ড না দেওয়ার জন্য অনুকম্পা চাওয়াসহ জামায়াত সম্পর্কে তাদের আইনজীবীর বক্তব্য শুধু জামায়াতের রাজনৈতিক পরাজয় নয়, তাদের নৈতিক পরাজয়ও বটে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.