মত-অমত

মাদ্রাসায় দান নয়, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নিয়ে লেখা-পড়া শেখান

বাংলাদেশের অধিকাংশ মাদ্রাসা চলে মানুষের ধর্মপ্রাণ মানুষের দান, কোরবানীর চামড়া ও যাকাতের অর্থে। যদিও এই টাকা থেকে মাদ্রাসার ছাত্ররা যে খুব বেশি উপকারী হয় এমন নয়। বরং মাদ্রাসা-এতিমখানার পরিচালকারই উপকার (!) বেশি পায়। অন্যদিকে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করে কোমলমতি শিশুদের। হেফাজতে ইসলামের কর্মকা- এর অন্যতম উদাহরণ। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যে যাকাত দেয়, তা নিজেদের ধর্ম বিশ্বাস থেকেই দেয়। কিন্তু সেই সেই টাকায় চলে ধর্মের নামে ব্যবসা আর রাজনীতি।

2013-04-08-12-10-58-5162b3d212717-sarailp1ঢাকা জার্নাল: মাদ্রাসার ছাত্ররা ব্যাকডেটেড, ওরা স্বাভাবিকভাবে কিছু দেখতে পারে না, ‘ওদের জীবন বোধ এখনও দেড় হাজার বছর আগের’ এসব কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি। ‘আধুনিক’, ‘শহুরে’ মানুষজনের মাদ্রাসার ছাত্রদের প্রতি একধরণের অবজ্ঞা সবসময়ই রয়েছে। থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। দেশের মোটামুটি বড় একটা জনগোষ্ঠী যখন একদিকে চলে তখন ভিন্ন একটা স্রোতকে অবজ্ঞা-নীচ দৃষ্টিতে দেখা হয়ই। তবে সমস্যা হলো এই ‘স্বাভাবিক’ জীবন স্রোতের মানুষরাই অর্থ্যাৎ আমরাই কিন্তু মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষকতা করি। আর দোষ দেই রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র কিছু করছে না, এখনই মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়া উচিত, মাদ্রাসা থাকলে হেফাজতের এমন দু:সাহস থাকবেই, কেন মাদ্রাসা বন্ধ হচ্ছে না? এমন হাজারো প্রশ্ন আমরা প্রতিনিয়তই করি।

কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, কেন সমাজের দরিদ্র শ্রেনীর মানুষ তার সন্তানকে মাদ্রাসায় পাঠায়? বিষয়টি শুধুই পারলৌকিক?

আমার মনে হয় পারলৈাকিক ব্যাপারের চেয়েও বিষয়টি অনেক বেশি অর্থনৈতিক। কিভাবে?
একজন দরিদ্র দম্পতির একাধিক সন্তান থাকে (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে)। তাদের সকলের জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় সংস্থান জোটাতে ওই পরিবারের পুরুষ কিংবা নারীর অবস্থা হয়ে যায় কেরোসিন। তারা তখন চিন্তা করে সন্তানকে যদি মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেই তবে অন্তত খাওয়া-পরার চিন্তা থাকবে না। কিন্তু তারা এটা ভাবতে পারে না যে, মাদ্রাসায় পাঠানো এই সন্তানটিকে স্কুলে পাঠালে ভবিষ্যত আরো উজ্জ্বল হবে। তাৎক্ষনিক ভাত-কাপড়ের অভাবে এই চিন্তা আসাটা অস্বাভাবিক।

তাহলে কি এভাবে চলতে থাকবে? এভাবেই কি সময়ে সময়ে মতিঝিল-শাহবাগ আক্রান্ত হবে? কিংবা কাঁচপুর-হাটহাজারী হবে? গরীবের এই সন্তানদের নিয়ে আল্লামা নামধারী শয়তানরা আর বাবুনগরীরা নিজেদের আখের গোছাবে? রাষ্ট্র কি শুধুই পুলিশ পাঠিয়ে মাঝে মাঝে অবস্থান থেকে হটিয়ে দেবে? আমাদের কি কিছুই করার নেই?

রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে কথা বলতে গেলে এখানে দীর্ঘ দিনের রাজনীতির বিষয়গুলো টেনে আনতে হবে। এখানে আমার কথা হচ্ছে আমরা ব্যক্তিক পর্যায় থেকে কিভাবে মাদ্রাসার লাগাম টানতে পারি।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মাদ্রাসা চলে মানুষের ধর্মপ্রাণ মানুষের দান, কোরবানীর চামড়া ও যাকাতের অর্থে। যদিও এই টাকা থেকে মাদ্রাসার ছাত্ররা যে খুব বেশি উপকারী হয় এমন নয়। বরং মাদ্রাসা-এতিমখানার পরিচালকারই উপকার (!) বেশি পায়। অন্যদিকে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করে কোমলমতি শিশুদের। হেফাজতে ইসলামের কর্মকা- এর অন্যতম উদাহরণ। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যে যাকাত দেয়, তা নিজেদের ধর্ম বিশ্বাস থেকেই দেয়। কিন্তু সেই সেই টাকায় চলে ধর্মের নামে ব্যবসা আর রাজনীতি।

মাদ্রাসার গরীব শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা যদি স্কুল-কলেজে নিজেদের সন্তান পাঠাতে পারে তবে মনে হয় এই সমস্যার সমাধান অনেকখানিই সম্ভব। তারা যদি অন্তত এটুকু বুঝতে পারে যে স্কুল-কলেজে পড়ে তার সন্তান অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে, মোটামুটি জীবন ধারণের জন্য আয় করতে পারে তবে তারা তাদের সন্তান আর মাদ্রাসায় পাঠাবে না। কিন্তু এ কাজে তাদের বাধা হয়ে দাঁড়ায় অর্থনৈতিক অসক্ষমতা। আর ঠিক এখানেই স্বচ্ছলরা ভূমিকা রাখতে পারেন।

কিভাবে করবেন?

প্রতিবছর যে যাকাত আপনারা শাড়ি-লুঙ্গি কিনে গরীবদের দেন কিংবা সরাসরি মাদ্রাসায় দান করেন সেটা নাকরে একটু ভিন্ন পথ অবলম্বন করলেই হয়। একটু উদ্যোগী হয়ে কয়েকজন মিলে যদি যাকাত-চামড়ার টাকা বা দানের টাকা জড়ো করে টাকার অনুপাতে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে পারেন। সরকারি প্রাথমিক স্কুলে বই বিনা পয়সায় দেয়া হয়। দুপুরের খাওয়াও অনেক স্কুলে দেয়া হয়। প্রয়োজন হয় পোশাক আর খাতার কলমের দাম। সব দিক বিবেচনায় প্রতি মাসে একজনের পিছনে তিন হাজার টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়। সে হিসেবে বছরে লাগে ৩৬ হাজার টাকা। দুপুরের খাওয়ার মূল্য হিসাব করে যদি অভিভাবকের হাতে কিছু টাকা দেয়া যায় তবে আরো ভালো। ৫ জন মানুষ যদি ২০ হাজার টাকা করেও যাকাত দেন তাহলে হয় ১ লাখ টাকা। নিজেই হিসাব করেন কয়জনকে পড়ানো সম্ভব। এর সাথে কোরবানীর চামড়ার দাম আর অন্য দানের টাকাতো আছেই। নিজের এলাকায় এভাবে যদি অন্তত ৫ জনতে স্কুলে পড়ানো যায় তবে ওই ৫ জন অন্তত মাদ্রাসায় যাবে না। আর এরকম উদ্যোগ নিলে অনেকেই পাশে দাঁড়াবে।

এভাবে কি করা সম্ভব না?

কে এস হক
লেখক- অনলাইন একটিভিস্ট ও সাংবাদিক

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.