মত-অমত

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ শুরু হলে কী ক্ষতি হতে পারে বাংলাদেশের?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

ইজরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর এখন আন্তর্জাতিক সব গণমাধ্যম সমর বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য ঊদ্ধৃতি দিয়ে প্রচার করছে যে পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে একটি পুরোপুরি যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কারণ ইজরায়েল বলেছে ইরান বড় ভুল করছে এবং পাল্টা জবাব দেয়া হবে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা চলছে। বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত তেলের দামও বাড়তে শুরু করেছে। অপরিশোধিত তেলের দাম কম থাকার সুযোগ নিয়েই দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর রাস্তা খুঁজছিল সরকার। তবে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ব্যারেলপ্রতি ৭০ ডলারে নেমে গেলেও বাংলাদেশ  সরকার দাম কমায়নি। তাই বিশ্ববাজারে তেলের দাম হ্রাসের খুব একটা প্রভাব বাংলাদেশে কখনও পড়েনি। এখন যে বাড়ছে তার প্রভাব পড়বে কিনা সেটা নিয়েই ভাবতে হচ্ছে।

গত বছর অক্টোবরে ইজরায়েলে হামাসের আক্রমণের পর থেকে এই এক বছরে গাজা ও অন্যান্য ফিলিস্তিন এলাকায় ইজরায়েলের অভিযান চলছেই। লেবাননে হামলা করে ইজরায়েল ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহর প্রধান নসরুল্লাহসহ পুরো নেতৃত্বই নির্মুল করে দিয়েছে। এর পর থেকেই আশঙ্কাল করে দিয়েছে। এর পর থেকেই আশংকা করা হচ্ছিল যে ইরান প্রতিশোধ নেবে এবং সেটাই হয়েছে। এর আগে সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলার প্রতিশোধ হিসেবে সম্প্রতি ইজরায়েলে ইরানের ড্রোন এবং রকেট হামলা করলেও সেটির কোন বড় প্রতিক্রিয়া দেখায়নি ইজরায়েল। তবে এবার মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ইজরায়েলের আগ্রাসী আচরণে।

মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের ব্যাপ্তি বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে অর্থনীতি,বৈদেশিক বাণিজ্য এবং জ্বালানি তেল নিয়ে সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সংঘাত দীর্ঘ হলে জ্বালানি তেলসহ নানা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। জ্বালানি তেল নিয়েই ভাবনাটা বেশি। কারণ জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ। এলএনজি বা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসও আসে এই অঞ্চল থেকে।

যুদ্ধ বিস্তৃত হলে এই খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালনি খাতে সমস্যা দেখা দেবে, শিল্প উৎপাদন ও পরিবহন খাত ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। সৌদি আরব, কুয়েত,কাতার,বাহরাইন,দুবাই থেকে জ্বালানি তেল আসে বাংলাদেশে। কাতার থেকে আসে এলএনজি। এগুলো পরিবহনের জন্য রয়েছে দুইটি পথ হরমুজ প্রণালি ও লোহিত সাগর (রেড সি)৷ লোহিত সাগর শুধুমাত্র সৌদি আরবের জন্য কিছুটা সহজ। কিন্তু অন্যদের জন্য হরমুজ প্রণালি। এখন লোহিত সাগরে ইরান সমর্থিত হুতিদের হামলা হলে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বাংলাদেশ জ্বালানি তেল ও এলএনজির সংকটে পড়বে।

নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যেও। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের শ্রম বাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। সেইসঙ্গে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগেও নেতিবাচক প্রভাব আসতে পারে। দুবাই থেকে বাংলাদেশে নির্মাণ কাজের জন্য বিটুমিন ও পাথর আসে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রবাসীদের জন্য বাংলাদেশ থেকে ভোগ্য পণ্য,শাকসবজি রপ্তানি হয়। সমুদ্রপথে সমস্যা হলে তাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যদি শেষ পর্যন্ত আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হয় এবং এই যুদ্ধ যদি দীর্ঘ হয় তাহলে আমাদের অর্থনীতিতে সরাসরি দুটি নেতিবাচক প্রভাবের কথাই বলছেন অর্থনীতিবিদরা। প্রথমত যা আগেই বলা হয়েছে যে, আমাদের মূল জ্বালানি হলো তেল। আর এরজন্য আমরাসহ বিশ্ব মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল। এলএনজি আনতে হয় মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এখন এ পরিস্থিতিতে বাজার অস্থির হয়ে যাবে। দাম বাড়লে আমাদের এখানে পণ্য উৎপাদন,শিল্প উৎপাদন,পরিবহন সবখানে খরচ ও দাম বেড়ে যাবে। এতে রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ যেসব শিল্প উৎপাদন গ্যাস বিদ্যুৎ নির্ভর সেখানে সমস্যা হবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শ্রমবাজারেও প্রভাব পড়তে পারে বলে আশংকাও আছে।

অন্তবর্তী সরকারের দিক থেকে এখনও কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে ভাববার প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশের চাওয়া একটাই যেন এই সংঘাত গোটা অঞ্চলে ছড়িয়ে না পড়ে।

লেখকঃ সাংবাদিক