শিক্ষা-সংস্কৃতিসব সংবাদ

ভিকারুননিসায় অতিরিক্ত আরও ৭ শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি, প্রধান বিচারপতির কাছে অভিযোগ

২০১৯ শিক্ষাবর্ষে অতিরিক্ত ৪৪৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগে সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান থাকা অবস্থায় নতুন করে আরও ৭ শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়েছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ। এই ঘটনায় প্রধান বিচারপতির কাছে কয়েকজন অভিভাবক গত ২৩ অক্টোবর লিখিত অভিযোগ করেন।

রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানে ২০১৯ শিক্ষাবর্ষের কোনও শিক্ষার্থী অন্যকোনও প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তরিত হয়নি। তারপরও নতুন করে শিক্ষার্থী ভর্তির কারণে প্রধান বিচারপতির কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন অভিভাবকরা।

প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন

প্রধান বিচারপতির কাছে লিখিত আবেদনে অভিভাবকরা উল্লেখ করেন, ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যাপারে একটি নোটিশ জারি করা হয়। ওই নোটিশের বিরুদ্ধে ২৮ জানুয়ারি হাইকোর্টে রিট মামলা (২৮০/২০২০) করা হয়। ওই রিটে ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষকে শোকজ করেন আদালত। ওই রিট এখনও নিষ্পত্তি হয়নি এবং ভর্তি কার্যক্রম রিটের কারণে বন্ধ ছিল।

কিন্তু ভর্তি শিক্ষার্থী ভর্তি চেয়ে ২৯ জানুয়ারি হাইকোর্টে আরও একটি রিট (৩৩২৬/২০২০) করেন অভিভাবকদের একটি পক্ষ। এই রিটের দোহাই দিয়ে গত ২২ অক্টোবর ফলাফল প্রকাশ করেন অধ্যক্ষ। গত ২৪ থেকে গত ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তির সময় বেধে দিয়ে নোটিশও করে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ।

লিখিত আবেদনে অভিভাবকরা আরও উল্লেখ করেন, দুর্গাপূজার ছুটি এবং করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মধ্যে শিক্ষার্থী ভর্তির উদ্যোগ কেন নেওয়া হলো? এখানে অবশ্যই বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি টাকা-পয়সা লেনদেনের আশঙ্কা থাকে।

নতুন ভর্তি পরীক্ষা কার্যক্রম বাতিল

৪৪৩ জন অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগের পর নতুন করে ২০২০ শিক্ষাবর্ষে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত আরও ৮৫৯ জন শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় ১৩ জানুয়ারি। মূল ক্যাম্পাসসহ শাখা ক্যাম্পাসে এই শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য গত ১৬ জানুয়ারি সকাল ১০টা থেকে ২১ জানুয়ারি রাত ১১টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত অনলাইনে আবেদন নেওয়া হয়। ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় গত ২৪ জানুয়ারি। তবে অতিরিক্ত ভর্তি নিয়ে মামলা জটিলতায় গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বর্তমান অধ্যক্ষ নোটিশ দিয়ে পরীক্ষা প্রক্রিয়া বাতিল করেন। ভর্তি পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের আবেদনের অর্থও ফেরত দেন তিনি।

বাতিল পরীক্ষার ফল প্রকাশ বর্তমান অধ্যক্ষের বক্তব্য

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশে গত ২২ অক্টোবর বাতিল করা পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর নোটিশ দেন অধ্যক্ষ ফওজিয়া রেজওয়ান। ৭৬৬ জনের শূন্য পদের বিপরীতে গত ২৪ থেকে ২৯ অক্টোবর ৭ শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়।

নতুন করে কেনও এই শিক্ষাবর্ষের শেষ সময়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়েছে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ ফওজিয়া রেজওয়ান বলেন, ‘শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশে ভর্তি করা হয়েছে। আসনের বিপরীতে ভর্তি করা হয়েছে। কোনও অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়নি।’

শিক্ষা বোর্ডের চিঠি

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শকের স্বাক্ষর করা চিঠিতে বলা হয়েছে, ভর্তি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী গত ২৪ জানুয়ারি দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়নি। কোনও কারণ ছাড়া ২৯ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পরীক্ষার কার্যক্রম বাতিল করা হয়। রিট পিটিশন ৩৩২৬/২০২০ -এর আদেশ মোতাবেক বেসরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাধ্যমিক, নিম্ন-মাধ্যমিক ও সংযুক্ত প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তির নীতিমালা অনুসরণ করে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ফল প্রকাশসহ বিধি মোতাবেক শিক্ষার্থী ভর্তি করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।

এর আগে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ অনধিক ৯০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির আবেদন জানায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে। এই চাহিদার কথা উল্লেখ করে গত ২০ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আরেকটি চিঠি দেন শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক। ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ নবম শ্রেণির প্রতিটি শাখায় ৭০ থেকে ৭৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে চেয়েছে যা ৯০ জনের উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত পাঠদান করাতে পারবে। ’ এই চিঠির পর নবম শ্রেণিতেও শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে বলে জানায় প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।

আদালতের আদেশের ভুল ব্যাখ্যার দাবি অভিভাবকদের

অভিভাবকরা বলছেন, অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়েছে আদালতের আদেশের ভুল ব্যাখ্যা করে। প্রধান বিচারপতির কাছে অভিযোগ দাখিল করা অভিভাবক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ভর্তি চেয়ে হাইকোর্টে দাখিল করা রিটের আদেশে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডকে বিষয়টি নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ঢাকা শিক্ষা বোর্ড নিষ্পত্তির না করে রিটের আদেশের কথা বলে সরাসরি ভর্তির নিদেশ দিয়েছে, যা আদালতের আদেশ উপেক্ষা করা হয়েছে। বাতিল করা পরীক্ষার ফল করোনা ও পূজার ছুটির মধ্যে দ্রুত প্রকাশ করে ভর্তি নেওয়া হয়েছে।’

আগের ৪৪৩ ভর্তি নিয়ে যত কাণ্ড

২০১৯ শিক্ষাবর্ষের জন্য ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে অতিরিক্ত ৪৩৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তিতে ওই সময়ের গভর্নিং বডিকে দায়ী করা হয় অধিদফতরের তদন্ত প্রতিবেদনে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনের পর ওই সময়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাসিনা বেগমের এমপিও বন্ধের নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর গভর্নিং বডির দুইজন সদস্য নন-এমপিও শিক্ষক ড. ফারহানা খানম ও নন-এমপিও শিক্ষক মুশতারী সুলতানার এমপিও কেন বন্ধ করা হবে না তা জানাতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির নির্বাচনে শিক্ষক প্রতিনিধি পদে তিনজন ও অভিভাবক প্রতিনিধি পদে ৬ জনকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়নি নির্বাচন কমিশন।

সাবেক অধ্যক্ষের রিট

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের গত ২৭ জানুয়ারির এমপিও বন্ধের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাসিনা বেগম। রিটের শুনানির পর মন্ত্রণালয়ের এমপিও বন্ধের আদেশ স্থগিত করেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এই স্থগিতাদেশ এখনও বহাল আছে।

ভিকারুননিসার শ্রেণি ব্যবস্থাপনা

ভিকারুননিসা স্কুল অ্যন্ড কলেজে খোঁজ নিয়ে যানা গেছে, তিন ফুট লম্বা বেঞ্চে মাত্র দুইজন শিক্ষার্থীকে কষ্ট করেই বসতে হয়। একটি ক্লাসে গাদাগাদি করে ৫টি কলামে আটটি করে বেঞ্চ হিসেবে ৪০টি বেঞ্চ স্থাপন করা যায়। এতে শিক্ষার্থী বসতে পারবে সর্বো্চ ৮০ জন। নতুন করে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি করা হলো তাতে সব শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকলে ১০ থেকে ১৫ জন করে প্রতিটি ক্লাসে তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

সূত্র বাংলা ট্রিবিউন