বিপ্লব বস্তিতে বস্তিতে
বিপ্লব বস্তিতে বস্তিতে ।। এস এম আববাস ।।
ঢাকা, ২৮ মার্চ, ২০১৬ (বাসস) : নোংরা জামা, ছেঁড়া প্যান্ট আর হাতে নেশার চুরুট। নেশার টানে কোনো না কোনো অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা চলে দিনভর। চোখের সামনে খুন হতে দেখেও অবাক হয়না এখানকার শিশু-কিশোররা। শুধু পুলিশি ঝামেলা এড়াতে কিছু সময় পালিয়ে থাকা। তারপর আবার দিন শুরু হয় অন্ধকার জীবনের।
এই চিত্র মাত্র ৮/১০ বছর আগের। প্রথম পাঁচ বছরে এর সামান্য পরিবর্তন হলেও তা চোখে পড়ার মতো ছিল না। তবে গত পাঁচ বছরে রাজধানীর আগারগাঁও বস্তির শিশুদের চিত্র পুরোটাই পাল্টে গেছে। দিন-রাত যেন বদলে গেছে ওদের।
শিশুরা শুধু পোশাক-পরিচ্ছদ কিংবা খেয়ে পরে ভাল আছে তা নয়, অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত তাও নয়। বিপ্লব আরো গভীরে। বিষয়টি রীতিমত গবেষণা করার মতো। এখন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আর শিশুদের নেশার জোগাড়ে ব্যস্ত হতে হয়না। স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি আর বিকেল হলেই মাঠে ক্রিকেট খেলতে যাওয়ার তাড়া থাকে ওদের।
আগারগাঁও বস্তিতে থাকা বরিশালের মুলাদী উপজেলা সফিপুর ইউনিয়নের চরমালিয়া গ্রামের বিথীর শুরুটি ছিল এনজিও পরিচালিত একটি স্কুলের মাধ্যমে। ওই বস্তির ‘সুরভী’ নামের স্কুলটি বদলে দিয়েছে তার জীবন।
পঞ্চম শ্রেণি শেষ করেই আগারগাঁও তালতলা সরকারি সরকারি কলোনী উচ্চ বিদ্যালয়ে নতুন ভর্তি হয়ে নতুন জীবন শুরু হয় বীথির। এরপর এসএসসিতে ভাল ফলাফল নিয়ে ভর্তি হয় মিরপুর বাংলা কলেজে। ২০১৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পা রাখে।
বীথি এখন একাউন্টিংয়ে মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। বিথীর মতো নুরহাজান, প্রসেনজিত, আল আমিনসহ জন ১৫ শিক্ষার্থী ২০১৫ সালে এইচএসসি পাস করেছে। ভর্তি হয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বস্তিতে এসএসসি পাশের হার উল্লেখযোগ্য। সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে- এখানকার প্রতিটি শিশুই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। বস্তির ব্র্যাক স্কুলটির পাশাপাশি আশে-পাশের সরকারি স্কুলে ভর্তি হয়ে রীতিমত লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছছে শিশুরা।
এখানেই শেষ নয়। খেলা-ধুলা চর্চাও চলে বড় বড় ক্লাবগুলোর স্টাইলে। ক্রিকেট খেলায় অন্য দলের সঙ্গে টি-টুয়েন্টি আদলে প্রতিযোগিতাও চলে আগারগাঁও যক্ষা নিরাময় কেন্দ্রের মাঠে। বস্তির এইচএসসি পাস করা আল আমিন কলেজে পড়াশুনার পাশাপাশি ফুটপাতে ফ্ল্যাক্সিলোডের দোকান দিয়ে সংসারের সহায়তা ও নিজের লেখাপড়ার খরচ চালায়। এখন দেশের বাইরে লেখাপড়া করার প্রস্তুতি নিচ্ছে আল আমিন।
এতো গেলো আগারগাঁও বস্তির কথা। রাজধানীর সবচেয়ে বড় বস্তি কড়াইল। এই বস্তি ছাড়াও কল্যাণপুর, তেজগাঁও, বেগুনবাড়িসহ প্রায় সব বস্তিতেই যেনো প্রতিযোগিতা সন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার। তিন বেলা খাবার জোগাড় করতে কপালের রক্ত-ঘাম পায়ে ফেলতে হয় যার, তিনিও চান কমপক্ষে মাধ্যমিক পাস করাতে। আর তা না পারলেও অন্তত প্রাথমিক স্কুল পাস করিয়ে তারপর কম্পিউটার শিখিয়ে অন্য কোনো কাজে লাগিয়ে দেওয়া চাই। বস্তির ছোট্ট শিশুরাও স্মার্টফোন চালাতে পারে। আর তা শিখতে নিজের স্মার্ট ফোন প্রয়োজন হয়নি তাদের।
আগারগাঁও বস্তির চা দোকানী বিউটির শিশু পুত্রের খোঁজ মেলে যক্ষা হাসপাতালের মাঠে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া ইয়াসিনকে বড়রা ডেকে নিয়ে যায় ক্রিকেট মাঠে। ভাল খেলার সুবাদে বড়দের প্রতিযোগিতায় খেলার সুযোগ পেয়েছে সে। বিউটির ইচ্ছে খেলার সুযোগ দিয়ে বড় ক্রিকেটার বানাতে হবে ছেলেকে। এমন স্বপ্ন বিউটিসহ বস্তির সব মায়েদের।
সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুর শিক্ষার পাশাপাশি কর্মজীবন নিরাপদ করতে বিভিন্ন সময় সরকার আইনি পদক্ষেপসহ প্রকল্পের ভিত্তিতে কাজ শুরু করে। সরকারের আনন্দ স্কুল থেকে বেসরকারি পর্যায়ে টুনটুনির পাটশালা তৈরি হয়েছে পথশিশুদের জন্য। সরকারের অসংখ্য পদক্ষেপ রয়েছে শিশুদের কল্যাণে।
বিভিন্ন সময় আইন ও নীতিমালা করেছে সরকার। ১৯৭৪ সালের শিশু আইন এবং শিশু ও শ্রমিকদের কল্যাণে ২০০৬ সালের শ্রম আইন ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়েছে। এছাড়া জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি-২০১১ এবং জাতীয় শ্রমনীতি-২০১২ পাস করা হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় শিশু কল্যাণ ট্রাস্টও গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে নানা পদক্ষেপ।
বস্তিতে বাস করা সচেতন ব্যক্তিদের মতামত হচ্ছে সব বস্তিতেই সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রয়োজন, প্রয়োজন খেলার মাঠের। সরকারি সহযোগিতায় যতটা এগিয়ে গেছে বস্তির মানুষগুলো সমাজের চারপাশের মানুষ উদ্যোগ নিলে বস্তির প্রতিটি বাড়িতেই জ্বলবে শিক্ষার আলো। প্রতিটি গলির অন্ধকার দূর হবে সহজেই।
সমাজের বিত্তবান এবং ব্যবসায়ীদের সামজিক দায়বোধ হয়তো সেই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা তৈরি করতে পারে। এমন ভাবনা থেকেই নিজের সংগ্রামের কথা বলেছেন বিথীর বাবা খোকন ব্যাপারিসহ বিভিন্ন বস্তির সচেতন অভিভাবকরা।
রাজধানীর বিভিন্নœ বস্তিতে যখন এই নিরব বিপ্লব সম্ভব হয়েছে, তখন আরো একধাপ এগিয়ে নেওয়ার দায় সরকারের। আর সেই দায় থেকেই সামাজিক দায়বধ্যতা সৃষ্টির উদ্যোগও নিয়েছে সরকার।
বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোকগণনা ২০১৪-এর ফলাফল অনুযায়ী রাজধানীর ৩৫টি বস্তিতে বাস করেন ২২ লাখ ৩২ হাজার ১১৪ জন মানুষ। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও মোস্ট অ্যাট রিস্ক অ্যাডোলসেন্ট (এমএআরএ) নামের দু’টি প্রতিষ্ঠানের ২০১২ সালের জরিপ অনুযায়ী, রাজধানীতে রয়েছে ৩ লাখেরও বেশী পথশিশু।
বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ হয়তো বস্তির শিশুদের জীবনে এ পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছে। কিন্তু এর ধারাবাহিকতা রক্ষা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
সবশেষে পথশিশুসহ সুবিধা বঞ্চিত শ্রমজীবী শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় শিশুদের জন্য জাতীয় সামজিক দায়বদ্ধতা নীতির খসড়াও প্রস্তুত করেছে সরকার। আর এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে কিশোরদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পাশপাশি নতুন আরো একটি বিপ্লব সূচিত হতে পারে বস্তিবাসী শিশুদের জীবনে।
বাসস-ইউনিসেফ ফিচার
ঢাকা জার্নাল, মার্চ ২৯, ২০১৬।