বিনোদনসব সংবাদ

বিজ্ঞানের খরা কাটিয়ে বাংলা ছবিতে সময়ের ছুট

13বিরিঞ্চিবাবার ক্ষমতা ছিল অগাধ। যোগবলে তিনি যাকে তাকে যে কোনও যুগে পৌঁছে দিতে পারতেন। বিশ্বযুদ্ধের আগের কালে পিছিয়ে গিয়ে লোহা কিনে রাখলেন কেউ। আবার যুদ্ধের পরে ফিরে এসে সেই লোহা বেচে ধনপতি হয়ে গেলেন। এমনটা নাকি হামেশাই ঘটত।

পরশুরামের গল্পে যেটা যোগবল, কল্পবিজ্ঞানে সেটাই টাইম-ট্রাভেল। অর্থাৎ সময় থেকে সময়ান্তরে যাতায়াত। বাঘা বাঘা বিজ্ঞান-লিখিয়েরা এ নিয়ে লিখেছেন। হলিউড অজস্র ছবি বানিয়েছে। এত দিনে বাংলা ছবিতেও বিষয়টা এসে পড়ল, সৌজন্য অ্যাবি সেন। যেখানে মূল চরিত্র অ্যাবি একটি অত্যাশ্চর্য বড়ি খেয়ে তেত্রিশ বছর পিছিয়ে যায়। ২০১৩-র কলকাতা নিমেষে পাল্টে গিয়ে আশির দশকে ঢুকে পড়ে।

রিপ ভ্যান উইঙ্কল নয় কিন্তু। আশিতে
আসিও না-ও নয়। এখানে কেউ অনন্ত ঘুমিয়ে পড়ে না। কারও বয়সও পাল্টে যায় না। শুধু চরিত্রটা একটা সময়ে বাঁচতে বাঁচতে আর একটা সময়-পর্বে গিয়ে পড়ে। সজ্ঞানে, স্ব-ইচ্ছায়।

আরও একটা তফাৎ আছে। সেটা কল্পবিজ্ঞান বনাম বিশুদ্ধ কল্পনার। টাইম-ট্রাভেল বা গ্রহান্তরের জীব বা অন্য যা কিছু কল্পবিজ্ঞানের গোত্রে পড়ে তখনই, যখন তার পিছনে কল্পনা আর বৈজ্ঞানিকতার একটা মিশেল থাকে। বিজ্ঞান-গবেষণার কিছু সূত্র কাজে লাগে। তার ভিত্তিতেই টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি-র মতো উপন্যাস লিটল মারমেড-এর গল্পের চেয়ে ঘরানাগত ভাবে আলাদা হয়ে যায়। ঠিক যেমন অ্যাবি সেন-এর পরিচালক অতনু ঘোষ ধরিয়ে দিচ্ছেন, বিজ্ঞানের একটা সূত্র বলে যে, সময় বৃত্তাকার। যদি তা-ই হয়, তা হলে একটা কোনও মুহূর্তে সময়ের শুরু আর শেষ মিলে যাওয়ার কথা। টাইম-ট্রাভেলের ধারণা তত্ত্বগত ভাবে সম্ভব হওয়ার কথা। অ্যাবি-র কাহিনি সেই তত্ত্বেই আশ্রয় নেয়।

বাঙালি পাঠকের কাছে কল্পবিজ্ঞানের গল্প এমনিতে বেশ
প্রিয়। এইচ জি ওয়েলস থেকে রে ব্র্যাডবেরি, আর্থার সি ক্লার্ক থেকে আইজাক আসিমভ বাঙালি ভালবেসে পড়েছে। অ্যাবি সেনের মতো এ রাজ্যের অনেক যুবকই সাই-ফাই ছবিরও পোকা। সেই তালিকায় হালের ইন্টারস্টেলার-গ্রাভিটি-অবতার বা জুরাসিক পার্ক যেমন আছে, তেমনই ব্যাক টু দ্য ফিউচার, ই.টি, ক্লোজ এনকাউন্টার্স অব দ্য থার্ড কাইন্ড-ও আছে। আছে ২০০১ স্পেস ওডিসি, মিডনাইট ইন প্যারিস বা সোলারিস-এর মতো ভিন ধারার ছবিও।

এর পাশে রাখা যেতে পারে বাঙালির নিজস্ব কল্পবিজ্ঞান চর্চা। সেখানে ঘনাদা, প্রোফেসর শঙ্কুরা আছেন। এক কালে ছোটদের পুজোসংখ্যায় ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্যের গল্প খুবই জনপ্রিয় ছিল। অদ্রীশ বর্ধনের লেখার ভক্তও কম নয়। অথচ বাংলা ছবিতে ‘পাতালঘর’-এর মতো ব্যতিক্রমী উদাহরণ বাদ দিলে কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি কিন্তু দেখা যায়নি সে ভাবে। কেন? চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের মতে, বাজেট এবং প্রযুক্তির অভাব একটা বড় কারণ। সেই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ভারতীয় সমাজ
এখনও বিজ্ঞানকে পাশ্চাত্যের বিষয় বলেই মনে করে। সমাজজীবনে বৈজ্ঞানিকতার ভিত্তি এখনও তত মজবুত নয়। তাই ঘনাদাকে সহজে গুলবাজ ভেবে নেওয়া যায়, গোয়েন্দা গল্পেও বিজ্ঞান-তথ্যের ব্যবহার বুনিয়াদি স্তরের চেয়ে এগোয় না।

সত্যজিৎ রায় নিজে প্রোফেসর শঙ্কুর মতো চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ বা ‘সেপ্টোপাসের খিদে’-র মতো গল্প লিখেছেন। কিন্তু তাই নিয়ে ছবি করেননি। তাঁর স্বপ্নের ‘অ্যালিয়েন’ হলিউডে বানাতে চেয়েছিলেন। হয়নি। সন্দীপ রায় শঙ্কু-কাহিনি নিয়ে ছবি করার স্বপ্ন লালন করেন অবশ্য। কিন্তু তিনিও বাজেট আর প্রযুক্তির সমস্যাকে এগিয়ে রাখছেন। একই মত সৃজিত মুখোপাধ্যায়েরও। বাংলা ছবি এখন বিদেশি লোকেশনে শ্যুটিং করে। কিন্তু সৃজিতের কথায়, কল্পবিজ্ঞানে কল্পনার যে লাগামহীন ছুট, সেটা রূপায়িত করার সামর্থ্য টালিগঞ্জের এখনও হয়নি। সে জন্যই ঘনাদা অনুপস্থিত। শঙ্কু-র একশৃঙ্গ অভিযান বা নকুড়বাবু ও এল ডোরাডো নিয়ে ছবি করার ইচ্ছে এখনও অপূর্ণ।

বাংলার মতো টানাটানির সংসার হলিউডের নয়। বাজেট আর প্রযুক্তির দেখনদারি তাই সেখানে সাই-ফাই ছবির অন্যতম রসদ। টাইম ট্রাভেল, স্পেসশিপ বা অ্যালিয়েন— অধরা নয় কিছুই। হিন্দিতে ‘কোই মিল গয়া’-উত্তর ‘কৃষ’ সিরিজ কিন্তু দেশি সুপারম্যানের গল্পে পর্যবসিত।

‘অ্যাবি সেন’ এ বার একটা মঝঝিম পন্থা উস্কে দিল। তপন সিংহের ‘এক যে ছিল দেশ’ যেমন  নার্কো বা পলিগ্রাফ টেস্ট-এর গল্প ছিল না। অ্যাবি-কাহিনিতেও বিজ্ঞানের কর্মকাণ্ড দেখানোর দরকার হয় না। টাইম-ট্রাভেল সেখানে দুটো সময় আর একটা চরিত্রের যোগসূত্র কেবল।

কল্পবিজ্ঞানও হল, বাজেট-দস্তুর বাঙালিয়ানাও রইল। নয়া ঘরানার ইঙ্গিত নয় কি?

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.