রাজনীতি

বিএনপির বিপরীতে ‘ছায়া কর্মসূচি’ নিয়ে মাঠে থাকবে আ.লীগ

তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সরকারের পদত্যাগসহ নানা ইস্যুতে সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলন বিস্তৃত করার চেষ্টা করছে বিএনপি। সরকারকে চাপে রাখার বিরোধীদের এই কৌশলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করবে আওয়ামী লীগ। রাজপথ দখলে রাখতে বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচির বিপরীতে ‘ছায়া কর্মসূচি’ দিয়ে মাঠে থাকবেন দলটির নেতাকর্মীরা।

বিরোধীদের কর্মসূচি দেখে তাৎক্ষণিকভাবে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। একইভাবে কর্মসূচি পালন করবে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোও। এমনটা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারা।

তারা বলছেন, বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে সরকারবিরোধী আন্দোলন করলেও সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণে সুবিধা করতে পারেনি। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি তো দূরের কথা, উল্টো আন্দোলনে ব্যর্থতার জন্য চাপে ছিল দলটি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঢাকার জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের তৎপরতা বেড়েছে। এতে চাপ তৈরি হওয়ায় বিরোধীদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে আগের মতো শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারছে না সরকার।

পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের এমন বাস্তবতায় সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলন জনসম্পৃক্ত নানা ইস্যুতে বিস্তৃত করার চেষ্টা করছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। এটিকে বিদেশিদের কূটনৈতিক চাপের সঙ্গে বিরোধীদের রাজনৈতিক চাপ তৈরির কৌশল হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে বিরোধীরা যাতে সফল হতে না পারে, সে জন্য ছায়া কর্মসূচি নিয়ে মাঠ দখলে রাখার পাল্টা কৌশল নিয়েছে দলটি।

সরকারি দলের দুজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দুজন সাংগঠনিক সম্পাদক জানিয়েছেন, দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতারা পর্যন্ত নেতাকর্মীদের সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাৎক্ষণিক যেসব কর্মসূচি দেওয়া হবে, তাতে অঙ্গ-সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদেরও অংশ নিতে বলা হয়েছে। তবে বিরোধীদের সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে সতর্কভাবে কর্মসূচি পালনের বার্তা দেওয়া হয়েছে।

চলতি মাসের শুরুতে বিএনপির চলমান আন্দোলনে বিদ্যুৎ সংকটসহ জনসম্পৃক্ত ইস্যু যুক্ত হওয়ার পর রাজপথে নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগকে। বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচি ঘোষণার পরই একই দিন রাজধানীতে ‘শান্তি সমাবেশ’ ঘোষণা করে আসছে ক্ষমতাসীন দল। এবার রাজধানীর পাশাপাশি বিভাগীয় শহর, জেলা শহরেও সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং উন্নয়ন প্রচারে কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে। এসব কর্মসূচিও বিএনপির কর্মসূচির বিপরীতে পালন করা হবে বলে আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, বিএনপি তাদের কর্মসূচি পালন করছে, সরকার বা আওয়ামী লীগ তাতে বাধা দিচ্ছে না। আমরা আমাদের কর্মসূচি পালন করছি। এটা রাজনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিএনপি যাতে কর্মসূচির নামে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য আওয়ামী লীগ সতর্ক রয়েছে। সামনে নির্বাচন থাকায় আমাদের কর্মসূচি আরও বাড়বে, এটাই তো স্বাভাবিক।

সহযোগী সংগঠনগুলোকে পৃথক কর্মসূচি পালন না করে আওয়ামী লীগের সমাবেশে অংশ নিতে বলা হয়েছে। এতে বিরোধীদের সঙ্গে সংঘাতের ঝুঁকি এড়ানোর পাশাপাশি নিজেদের শক্তি প্রদর্শনও ত্বরান্বিত হবে। ২৮ মে ঢাকা মহানগর ও সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যৌথসভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক স্পষ্ট জানিয়ে দেন, এখন সবার ইউনাইটেডলি মুভ করতে হবে, কোনও ছাড় নেই। আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে সহযোগীসহ অন্য সংগঠনের নেতাকর্মীদের অংশ নিতে হবে।

দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম  বলেন, আওয়ামী লীগ মাঠে থাকায় বিএনপির আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে। এখন তারা আগামী নির্বাচন সামনে রেখে মার্কিন ভিসানীতি ও নানা ইস্যুতে ফের আন্দোলন জমাতে চাইছে। তাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে আমাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। বিএনপি যাতে অঘটন ঘটিয়ে আওয়ামী লীগের ওপর দায় চাপাতে না পারে, সে ব্যাপারে নেতাকর্মীদেরও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

গত ২ জুন তরুণদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় ঢাকাসহ ছয় বিভাগ ও বগুড়া জেলায় সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল বিএনপি। তার দুদিন পর ৪ জুন যুবলীগ একই স্থানে একই সময় কর্মসূচির ডাক দেয়। পরে ৭ জুন সংবাদ সম্মেলন করে তারুণ্যের সমাবেশের তারিখ পরিবর্তন করার কথা জানায় বিএনপি। সে অনুযায়ী, ১৪ জুন চট্টগ্রাম, ১৯ জুন বগুড়া, ২৪ জুন বরিশাল, ৯ জুলাই সিলেট, ১৭ জুলাই খুলনা ও ২২ জুলাই ঢাকায় এই সমাবেশ করার কথা জানানো হয়।

এ বিষয়ে যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেন, তারুণ্যের সমাবেশের কমর্সচি ঘোষণার পর একই স্থানে একই সময় যুবলীগ কর্মসূচির ডাকায় আমরা সমাবেশ পিছিয়ে দিয়েছি। জিয়ার সৈনিকেরা সংঘাত চায় না বিধায় নতুন করে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। যুবলীগ আর তাদের কর্মসূচির পরিবর্তন না করে শুভবুদ্ধির পরিচয় দেবে। আমরা আর কর্মসূচি পেছাবো না।

পরদিন ৮ জুন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সাত বিভাগে শান্তি সমাবেশ সফল করতে ৮ জুন থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত প্রস্তুতি সভা করার কর্মসূচি দেয় যুবলীগ। ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, ৮ থেকে ১২ জুন চট্টগ্রামে, ১৫ থেকে ১৮ জুন রাজশাহী ও রংপুরে, ২০ থেকে ২৩ জুন বরিশালে, ৫ থেকে ৮ জুলাই সিলেটে, ১২ থেকে ১৬ জুলাই খুলনায় এবং ১৮ থেকে ২০ জুলাই ঢাকায় সমাবেশ সফল করতে প্রস্তুতি সভা করবে যুবলীগ।

এ বিষয়ে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ বলেন, একই দিনে যুবলীগের কর্মসূচি ঘোষণা করায় বিএনপি তাদের তারুণ্যের সমাবেশের তারিখ পরিবর্তন করেছে। তারা রাজনৈতিক মাঠ ও রাজপথ খালি চায় কেন, তা বুঝলাম না। খালি মাঠে গোল দেওয়ার তাদের সেই পুরনো স্বপ্ন, এখনও ভুলতে পারেনি। গণতন্ত্র মানে তো সহাবস্থানে রাজনীতি করা। সেই ভাষা বিএনপির জানা নেই অথবা তাদের কোনও দুরভিসন্ধি আছে। তাদের খালি মাঠে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে দেবে না যুবলীগ।

তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে, প্রতিদিন কোনও না কোনোভাবে এবং পর্যায়ে মাঠে থাকবে যুবলীগ। তবে সেই কর্মসূচি কেমন হবে, তা স্পষ্ট করেননি যুবলীগ চেয়ারম্যান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনটির একাধিক প্রেসিডেয়াম সদস্য জানান, বিএনপি এখন সরকারবিরোধী আন্দোলনে ভিন্নতা আনতে বিদ্যুৎ সংকটকে কেন্দ্র করে হাতে হারিকেন নিয়ে নেমেছে। ভবিষ্যতে তারা কেমন কর্মসূচি দেয়, তা দেখে যুবলীগ কর্মসূচি দেবে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুজন নেতা  বলেন, মার্কিন ভিসানীতির পর সরকারি দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে রাজপথে সংঘাতে জড়াতে পারে বিএনপি। যাতে সব দায় ক্ষমতাসীনদের ওপর দিয়ে পশ্চিমাদের চাপ আরও বাড়ানো যায়। সে কারণে বিরোধীদের সঙ্গে সংঘাতে না জড়াতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাদের বার্তা দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে বেশ সতর্ক নজর রাখা হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সাম্প্রতিক সমাবেশগুলোয় নেতাকর্মীদের সতর্ক করে বক্তব্য দিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি নির্বাচন চায় না; তারা চায় সংঘাত, অস্থিরতা, অশান্তি ও রক্তপাত। আমরা কারও সঙ্গে পাল্টাপাল্টি সংঘাতে যাবো না। কথায় কথায় আপনারা মাথা গরম করবেন না। তবে বিএনপি যাতে দেশে নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য আমরা মাঠে থাকবো।’

কোনও সংঘাতে যাওয়া যাবে না—আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার এমন নির্দেশনা উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের আরও বলেছেন, ‘আমরা সংঘাতে যাবো না, কিন্তু সংঘাত কেউ করতে এলে চুপ করে বসে থাকবো না। আমাদের ওপর যদি কেউ হামলা চালায়, তাহলে আমরা হামলা চালাবো না? হামলা করলে তার সমুচিত জবাব কীভাবে দিতে হয়, তা আওয়ামী লীগ জানে।’