Leadখেলাসংবাদ শিরোনাম

বাঙ্গালি, বিশ্বকাপের প্রতিশোধ নাও

Anandbazar_pic_667446375ঢাকা জার্নাল: শেরে বাংলায় প্রতিশোধের ম্যাচে ভারতকে হারিয়েছে ব্যাঘ্রবাহিনী। বিশ্বসেরা ব্যাটিংলাইন আপ নিয়েও কেন বাংলার সামনে এমন নতজানু হার ভারতীয় মিডিয়ায় এখন চলছে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ।

পাশাপাশি দীর্ঘদিনের ‘ঐতিহ্যের’ বরখেলাপ ঘটিয়ে ভারতীয় পত্রিকাগুলোতে এখন যেন চলছে বাংলাদেশ বন্দনা।

‘প্রতিশোধের ম্যাচে জয়’ কিংবা ‘মেলবোর্নের বদলা’ গতকালের ম্যাচটিকে বর্ণনা করতে এই শব্দগুলোই ঘুরে ফিরে হেডলাইন ভারতীয় মিডিয়ার।

‘ধোনির ভুল আর অজানা আতঙ্কে মেলবোর্নের বদলা’ এই শিরোনামে গতকালের ম্যাচকে ‘দাদাগিরির জবাবে প্রতিশোধ’ এই বিষয়টিকেই সামনে তুলে আনলো প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার।

প্রতিবেদক রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘ঠোঁটে চেপে ধরা ভুভুজেলা, ঠোঁটে চেপে ধরে পঁচিশ হাজার। অদ্ভুত নেশা ধরানো এক ছন্দে, চেনা একটা আওয়াজকে নকল করে বেজে চলেছে ক্রমাগত। চেনা যায়, ছন্দটা বড় চেনা যায়।’ ‘ম..ও..কা..ম..ও..কা’! চার মাস আগে ক্রিকেট বিশ্বকাপ এমনই কিছু রোজ শুনত না?

পাগলের মতো কাঁদতে-কাঁদতে গ্যালারি ধরে ছুটে চলেছে যে যুবক, তাঁর হাতটা কত জন খেয়াল করলেন কে জানে। চোখ দিয়ে জল ঝরছে অঝোরে, হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে একটা সাদা কাগজ। কাগজে কিছু একটা লেখা।

বুকে সজোরে ধাক্কা দেওয়ার মতো একটা লাইন লেখা ‘বাঙালি, বিশ্বকাপের প্রতিশোধ নাও!’

আরে, মীরপুর মাঠে মাঝরাতে কারা চেস্ট বাম্প করছেন? ভুল ভাবলেন। মোটেও ওঁরা লি-হেশ নন, ওঁরা দু’জন বাঙালি! চার মাস আগের ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে যাঁরা আজ তৃপ্ত। সন্তুষ্ট। যাঁরা হয়তো আজ রাতে আর ঘুমোবেন না। তাসকিন আহমেদের বুকের ধাক্কায় দেখা গেল, পড়তে-পড়তে বেঁচে গেলেন মাশরফি মর্তুজা। কিন্তু তাতে আজ কিছু এসে যায়?

বিশ্বকাপের কোর্য়াটার ফাইনালে বাংলাদেশের উত্থান যে ‍অযাচিত ছিলো না তার স্বীকৃতি দিয়ে আনন্দবাজার লিখেছে, ‘দুই প্রতিবেশীর এক যুদ্ধকে কী ভাবে ক্রিকেটের বাইশ গজ থেকে তুলে এনে জীবনের বাইশ গজে আছড়ে ফেলা যায়, দেখে নিল বৃহস্পতিবারের মীরপুর মাঠ। কোনও সন্দেহ নেই চার মাস ধরে পুড়ে চলা এক অপমানের বৃত্ত এ দিন মীরপুর মাঠে শেষ করে ফেললেন এগারো বাঙালি। কাপ কোয়ার্টার ফাইনালে হারের প্রতিশোধ নিয়ে। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ‘মহাভারত’-কে ধুলোয় মিশিয়ে। কিন্তু ম্যাচের সেটা একমাত্র আঙ্গিক ভাবলে চরমতম অন্যায় হবে। বাংলাদেশ দেখিয়ে দিল, বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল ফ্লুক ছিল না।

দেখিয়ে দিল, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ওয়ান ডে সিরিজ জয়কে আশ্চর্যের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার কোনও দরকার ছিল না। এশীয় ক্রিকেটে তো বটেই, গোটা ওয়ান ডে পৃথিবীতেই তারা এখন দুর্নিবার শক্তি। যারা ইংল্যান্ডকে হারাতে পারে। পাকিস্তানকে পারে। ভারতকেও পারে। পারে এক অজানা আতঙ্ককে লেলিয়ে দিয়ে।‘

‘রাত বারোটার মীরপুর প্রেসবক্সেও লিখতে বসে আবহে মহানাটকীয়তা দেখে হাত কাঁপবে। প্রতিশোধের ম্যাচে পাঁচ উইকেট নিয়ে ভারতকে কাঁপিয়ে গেলেন কে? না, উনিশ বছরের এক তরুণ বাঁ হাতি পেসার। যাঁকে এক বছর আগেও বাংলাদেশ ক্রিকেট চিনত না। অথচ ওই ছেলেই আজ রায়নাকে নিলেন। রোহিত শর্মাকে নিলেন। পাটা উইকেটে তাঁর স্লোয়ার আর কাটারে বশ্যতা স্বীকার করে নিল দুঁদে ভারতীয় ব্যাটিং। এ বার বাংলাদেশ সাংবাদিকদের দেখুন। আবেগে থরথরিয়ে প্রেসবক্সেই কাঁপছেন। দর্শকদের সঙ্গে চেঁচাচ্ছেন। ওঁদের অনেকে ছিলেন মার্চের মেলবোর্নে। দেখেছেন, মাশরফিদের কান্না। প্রেসবক্স থেকে বেরিয়ে বাইরের গ্যালারিতে দৃষ্টি নিয়ে যান। উদোম গায়ে, ঘামতে ঘামতে ওখানে এখনও উৎসব করে চলেছে উন্মত্ত দর্শক। জামা ওড়াচ্ছে, তাসা বাজাচ্ছে, চেয়ার চাপড়াচ্ছে। সত্যি বলতে, আবেগের এই ছবিকে সাদা পাতার কালো দাগে তুলে ধরা কঠিন নয়। অসম্ভব।’

একই সঙ্গে পরাজিত ভারত অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনিকেও মুস্তাফিজুরের সঙ্গে অভদ্র আচরণের জন্য কাঠগড়ায় তুলেছে পত্রিকাটি, ‘মাঝরাতের মহেন্দ্র সিংহ ধোনি? তাঁর অভিব্যক্তি ব্যাখ্যাও সম্ভব তো? পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে যে ভারত অধিনায়ককে দেখা গেল, মুখ তাঁর যন্ত্রণায় বেঁকেচুরে গিয়েছে। বিশ্বকাপের পর ওয়ান ডে-তে এটা তাঁর কামব্যাক ম্যাচ ছিল। এমএসডি রান পেলেন না। প্রয়োজনের দিনে দেশকে আবারও বাঁচাতে পারলেন না। অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠল। তবু সে সব নয়। ভারত অধিনায়ক এ দিন যা করলেন, তা তাঁকে সাধারণত করতে দেখা যায় না। মুস্তাফিজুরকে ভারত অধিনায়ক ধাক্কা মেরে বসলেন।

তবে এর কারণ হিসেবে বাংলাদেশ-ভারতের সাম্প্রতিক ক্রিকেট টানাপড়েনকেও অস্বীকার করলো না পত্রিকাটি।

‘ভারত ব্যাট করার সময় থেকেই লাগছিল। ইনিংসের প্রথম বল থেকে রোহিত শর্মার বিরুদ্ধে আউটের পরপর আবেদন, আর আবেদনের সমর্থনে পঁচিশ হাজার বাংলাদেশ দর্শকের কানফাটানো আওয়াজ ক্রিকেট স্পিরিটের বারোটা বাজানোর ইঙ্গিত দিচ্ছিল। যা পরবর্তী সময়ে আর আটকানো গেল না। রোহিতের সঙ্গে একবার তামিমের লেগে গেল। আম্পায়ার আবার কিছুক্ষণ পর তামিম আর মাশরফিকে ডেকে সতর্ক করে দিলেন আচরণ নিয়ে। বিরাটকে আউট করে তাসকিন আহমেদ যে চিৎকার করলেন, তাতে বোঝা যায় ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেট-সম্পর্ক এখন কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে। এমএসডি তিনিও যা থেকে প্রভাবমুক্ত থাকতে পারলেন না। রান নিতে যাওয়ার সময় ধোনির কাঁধ মুস্তাফিজুরকে এমন গুঁতিয়ে দিল যে, উনিশের পেসারকে মাঠের বাইরে চলে যেতে হল সঙ্গে সঙ্গে।

প্রত্যুত্তরটাও পেলেন ভারত অধিনায়ক। মুস্তাফিজুর ফিরে এসে ভারতকেই ম্যাচ থেকে ধাক্কা মেরে বার করে দিলেন।’

ভারতের সবচেয়ে বড় দুর্বলতার নাম যে বোলিং, সেটাও যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো আনন্দবাজার।

‘মোহিত শর্মা, ভুবনেশ্বর কুমাররা শিখতে পারেন তরুণ বাংলাদেশ পেসারের থেকে। ভারত যে আজ হেরে গেল, তার কারণ প্রধানত দু’টো। পেসারদের জঘন্য বোলিং সর্বাগ্রে থাকবে। ভারতের তিন পেসার মিলে কুড়ি ওভারেরও কমে দেড়শো দিলেন। ভুবনেশ্বর কুমার যে কোন যুক্তিতে ঘণ্টায় একশো পঁচিশ কিলোমিটার গতি নিয়ে শর্ট করতে থাকলেন, উত্তরটা একমাত্র তাঁরই জানা। কারণ টি-টোয়েন্টি প্রভাবিত বর্তমান ওয়ান ডে দুনিয়ায় একশো পঁচিশে শর্ট করে ব্যাটসম্যানকে বিপদে ফেলার স্বপ্ন দেখা যা, পাঁচ হাজার টাকার মাইনের চাকরি করে বিএমডব্লিউ চড়ার স্বপ্ন দেখাও তাই। তামিম ইকবাল, সৌম্য সরকাররা সবচেয়ে বেশি নির্দয় ছিলেন মোহিত শর্মার উপর। পাঁচ ওভারও পুরো করতে পারেননি মোহিত মারের চোটে। তার মধ্যেই ৫৩ দিয়ে চলে গিয়েছেন। উমেশ যাদব একটা ওভারে আবার আঠারো দিলেন।’

ম্যাচে ধোনির নেয়া সিদ্ধান্তগুলোকেও কাঠগড়ায় তুলেছে আনন্দবাজার। সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় ধোনিকে ‘সাহসী নন’ এমন খোঁচা দিতেও ছাড়েনি তারা।

‘এমএস ধোনির ভাগ্য ভাল, বাংলাদেশ সাড়ে তিনশোয় যায়নি। অথচ যাওয়ার যাবতীয় সম্ভাবনা ছিল। এই পিচে তিন পেসার নামানো ভুল হয়ে গিয়েছে বুঝে দ্রুত রায়নাকে দশ ওভার দিলেন। বিরাটকে দিয়ে স্লো মিডিয়াম পেস করালেন। ও দিকে স্টুর্য়াট বিনি ডাগআউটে বসে। যাঁর কি না গত সফরে এ মাঠেই ৪ রানে ৬ উইকেট আছে। অক্ষর পটেলও বসে। ক্যাপ্টেন ধোনির এখানে ভুল হয়ে গেল। ব্যাটসম্যান ধোনি তিনিও তো পারতেন আতঙ্কের দিনে নিজেকে ব্যাটিং অর্ডারে উপরে তুলে আনতে। ছক বাঁধা জীবনের বাইরে গিয়ে বিশ্বকাপ ফাইনাল এসেছিল। তিনিই দিয়েছিলেন। প্রয়োজনের দিনে আরও একটু সাহসী কি হওয়া যেত না?’

কেউ কেউ বলতে পারেন, বাংলাদেশও চার পেসার খেলিয়েছে। ধোনি আর ভুল তা হলে কোথায় করলেন? কিন্তু যে চার বাংলাদেশ পেসার খেললেন, তাঁরা কেউ একশো পঁচিশ কিলোমিটারে শর্ট করেন না। রুবেলের পেস একশো চল্লিশের কাছে। তাসকিনও তাই। মুস্তাফিজুর একমাত্র যাঁর পেস অতটা নেই। কিন্তু তাঁর পাঁচ উইকেট নিয়ে যাওয়ার পিছনে আছে পাটা উইকেটে বলকে কাট করানোর ক্ষমতা। স্লোয়ার দিয়ে ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করার ক্ষমতা।’

মোস্তাফিজুরের উদাত্ত প্রশংসা করে আনন্দবাজার লিখেছে, ‘এক বছর আগেও বাংলাদেশের কেউ তাঁকে চিনত না। নির্বাচক প্রধান টিমে বৈচিত্র বাড়ানোর জন্য এক জন বাঁ হাতি পেসার চেয়েছিলেন। তখনই বাকি নির্বাচকদের কেউ একজন এগিয়ে দেন মুস্তাফিজুরকে। যিনি আবার বাংলাদেশে কোচিং করাতে আসা ও-পারের রণদেব বসুর তত্ত্বাবধানেও ছিলেন। এত দিন পর্যন্ত মুস্তাফিজুরের নামী উইকেট বলতে ছিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি যুদ্ধে শাহিদ আফ্রিদি আর মহম্মদ হাফিজ। আজ থেকে কত নাম জুড়ে গেল। রোহিত শর্মা। অজিঙ্ক রাহানে। রবীন্দ্র জাডেজা।’

সব মিলিয়ে বাংলাদেশ যে আগের বাংলাদেশ নেই, বাংলাদেশ যে বদলে গেছে সেই বিষয়টিকে সামনে এনে পত্রিকাটি লিখেছে, ‘আসলে এটাই এখন বাংলাদেশ। যারা আর ক্রিকেটীয় হীনমন্যতায় না ভুগে নিয়মিত তুলে আনছে পরের পর প্রতিভা। কেউ বিকেএসপি থেকে উঠে আসছেন। যাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের আতুঁড়ঘর বলা হয়। কেউ বা আসছেন স্কুল ক্রিকেট থেকে। নামগুলো কখনও সৌম্য সরকার। কখনও তাসকিন আহমেদ। আজকের পর বাংলাদেশের পক্ষে সিরিজটা ১-০ হয়ে গেল। অঘটন বললে যে গৌরবকে অপমান করা হবে। ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম তিনশো, প্রথম উইকেটে প্রথম বারের জন্য একশো রানের পার্টনারশিপ করে দেওয়া, কোনটা বাকি থাকল। ভারত শেষ পর্যন্ত সিরিজ জিতবে কি না সময় বলবে। কিন্তু এমএসডি একটা ব্যাপার বুঝে মাঠ ছাড়লেন। এটা আর অতীতের বাংলা নয়। অন্য বাংলা। নতুন বাংলা। শের-ই-বাংলা!‘

ঢাকা জার্নাল, জুন ১৯, ২০১৫

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.