সারাদেশ

বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন ২৮ অক্টোবর

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল আগামী ২৮ অক্টোবর উদ্বোধন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থেকে এ মেগা প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন বলে কথা রয়েছে। টানেল উদ্বোধনকে ঘিরে চলছে নানা প্রস্তুতিও। তৈরি করা হচ্ছে উদ্বোধনী নামফলক। টানেলের দুই প্রান্তকে সাজানো হচ্ছে অপরূপভাবে। ১০ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের প্রথম এ সুড়ঙ্গপথ নির্মিত হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ  বলেন, ‘যানবাহন চলাচলের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত মূল টানেল। আগামী ২৮ অক্টোবর এটির উদ্বোধনের কথা রয়েছে। এখন টানেলের ভেতরে-বাইরে নিরাপত্তার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। টানেলের সুরক্ষার জন্য দুই পাশে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ ফাঁড়ির ভবন নির্মাণসহ অন্যান্য কাজ চলছে। টানেল প্রকল্পের অগ্রগতি ৯৯ শতাংশ। ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো কাজ শেষ হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘টানেলে নিরাপত্তায় ১০০টির বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। টানেলে চলাচলকারী গাড়ির গতিবেগ প্রথম দিকে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের বেশি হবে না। পায়ে হেঁটে টানেল পার হওয়া যাবে না। একইভাবে মোটরসাইকেল এবং তিন চাকার যানবাহনও চলাচল করবে না টানেল দিয়ে। নির্ধারিত ওজনের বেশি ভারী যানবাহন এ টানেল দিয়ে চলতে দেওয়া হবে না। এজন্য টানেলের প্রবেশমুখে নির্মাণ করা হয়েছে ওজন স্কেল। পরিমাপের পর বেশি হলে ওই যানবাহনকে পার হতে দেওয়া হবে না। কোন যানবাহন থেকে কী ধরনের টোল নেওয়া হবে তা ইতোমধ্যে নির্ধারণ করে ফেলেছে মন্ত্রণালয়।’

সম্প্রতি সরেজমিন পতেঙ্গা টানেল এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে টানেল। প্রবেশ পথে নৌবাহিনীর সদস্যদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। টানেল নির্মাণে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যতীত অন্য কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। পতেঙ্গা থেকে টানেলের প্রবেশমুখ পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে উদ্বোধনী ফলক। যেটি উন্মোচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুল প্রতীক্ষিত টানেলটি উদ্বোধন করবেন। এছাড়া টানেল এলাকাকে সাজানো হচ্ছে মনোরমভাবে। টানেলে দুটি মুখ রয়েছে। এর মধ্যে একটি পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় অপরটি আনোয়ারা প্রান্তে। দুই প্রান্তে দূর থেকে একনজর দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের ভিড় জমে।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্পটি পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। তখন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আগামী ২৮ অক্টোবর ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই দিন পতেঙ্গা প্রান্তে টানেল এর উদ্বোধন করা হলেও আনোয়ারা প্রান্তে হবে সুধী সমাবেশ। এতে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য রাখবেন।”

মুখ্য সচিব আরও বলেন, ‘এ টানেল শুধু দুই পাড়কে সংযুক্ত করেনি, ওয়ান সিটি টু টাউন কনসেপ্ট তা বাস্তবায়িত হয়েছে। তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটারের টানেলটি তিন মিনিট থেকে সাড়ে তিন মিনিটের মধ্যে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পার হওয়া যাবে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ১৮ থেকে ৩১ মিটার নিচে এ টানেল দিয়ে মানুষ চলাচল করবে। এটার সঙ্গে কক্সবাজারের যোগাযোগ অনেক সহজ হবে।’

চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক এমডি আবদুল মালেক  বলেন, ‘টানেল এর ভেতর অত্যাধুনিক ফায়ার সিস্টেম রয়েছে। পুরো টানেল মনিটরিংয়ের জন্য একটি কন্ট্রোল রুম রয়েছে। সেখান থেকে টানেলের ভেতর কী হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করা হবে। টানেলের ভেতর অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে তা কন্ট্রোল রুম থেকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ আছে। বেশি হলে তখন ফোর্স নিয়ে ভেতরে যেতে হবে। কোনও যানবাহন দুর্ঘটনার কবলে পড়লে কীভাবে সেটি উদ্ধার করা হবে এসব বিষয় নিয়ে আমাদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আগামী ২ অক্টোবর টানেলে চূড়ান্ত মহড়া অনুষ্ঠিত হবে। আমরা কীভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণ করবো এবং কীভাবে দুর্ঘটনাকবলিত যানবাহন উদ্ধারে সহযোগিতা করবো তা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।’

ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘টানেল প্রকল্পের দুই পাড়ে দুটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন হচ্ছে। স্টেশনের ভবন নির্মাণের কাজ চলমান। প্রথম শ্রেণির ফায়ার স্টেশন হলে কর্মকর্তা-সদস্য মিলে ৩৫ জন থাকবে। দ্বিতীয় শ্রেণির হলে থাকবে ২২ জন। তবে এখানে প্রথম শ্রেণির ফায়ার সার্ভিস স্টেশন হওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি।’

এদিকে টানেলের এক প্রান্তে (পতেঙ্গা) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) এরিয়া এবং অপর প্রান্ত (আনোয়ারা) জেলা পুলিশের সীমান্ত। সে অনুযায়ী টানেলের অর্ধেক সিএমপির এবং অর্ধেক জেলা পুলিশের অধীনে। সিএমপি এবং জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে দুই পাড়ে থানা প্রয়োজন। তবে টানেল কর্তৃপক্ষ পুলিশ ফাঁড়ির জন্য ভবন নির্মাণ করছে।

এ প্রসঙ্গে সিএমপির এডিসি (পিআর) স্পিনা রানি প্রামাণিক  বলেন, ‘টানেল সুরক্ষা দিতে দুই পাড়ে দুটি থানা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দফতরে এ প্রসঙ্গে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। পতেঙ্গা প্রান্তে প্রস্তাবিত থানাটির জন্য ৮১ জন জনবল চাওয়া হয়েছে। সদর দফতর কত জনবলের অনুমোদন দেয় তা দেখার বিষয়। কবে থেকে এ থানার কার্যক্রম শুরু হবে তা অনুমোদন পাওয়ার পর জানা যাবে।’

গত ১৩ জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের টোল হার নির্ধারণ করা হয়েছে। যানবাহনের শ্রেণি অনুযায়ী টোল হার চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সেতু বিভাগ।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী- তিন দশমিক ৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু টানেলে মোট ১২ ধরনের যানবাহনের টোল দিতে হবে। এই টানেলে মোটরসাইকেল চলতে পারবে না। সর্বনিম্ন টোল ধরা হয়েছে ২০০ টাকা। প্রাইভেটকার পারাপারে এই টোল দিতে হবে। প্রতিবার পিকআপ পারাপারে টোল ২০০ টাকা। মাইক্রোবাসের টোল ২৫০ টাকা। ৩১ আসনের কম বাসের টোল ৩০০ টাকা। ৩২ আসনের বেশি বাসের টোল ৪০০ টাকা। তিন এক্সেল বিশিষ্ট বড় বাসের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা।

পাঁচ টন পর্যন্ত পণ্য বহনে সক্ষম ট্রাকের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০০ টাকা। আট টনের ট্রাক পারাপারে ৫০০ টাকা এবং ১১ টনের ট্রাকে ৬০০ টাকা টোল দিতে হবে। তিন এক্সেলের ট্রেইলারে টোল লাগবে ৮০০ টাকা। চার এক্সেলের ট্রেইলারে দিতে হবে এক হাজার টাকা। পরবর্তী প্রতি এক্সেলের জন্য বাড়তি দিতে হবে ২০০ টাকা। টানেল যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার দিন থেকে এই টোল হার কার্যকর হবে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল চালু হলে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এক ধাপ এগিয়ে যাবে। টানেল চালু হলে চট্টগ্রাম নগরীর পরিধি বাড়বে। টানেলের এক প্রান্তে চট্টগ্রাম শহর। অপর প্রান্তে রয়েছে আনোয়ারা উপজেলা। শহরের খুব কাছে থাকলেও এ উপজেলা এতদিন অবহেলিত ছিল। টানেল নির্মাণের মধ্য দিয়ে আরেকটি শহরে রূপ নিচ্ছে আনোয়ারা। ইতোমধ্যে আনোয়ারা উপজেলায় জমির দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। আনোয়ারা উপজেলা প্রান্তে টানেল সংযোগ সড়কের দুই পাশে গড়ে উঠছে ছোট-বড় অসংখ্য শিল্পকারখানা। টানেল চালু হলে কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র তিন মিনিট। বেঁচে যাওয়া সময়ে অর্থনীতি গতি পাবে। টানেলকে ঘিরে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম নগরী এবং পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।’

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরে টানেলটি নির্মাণ করা হচ্ছে। মূল টানেলের দৈর্ঘ্য তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার। চার লেন বিশিষ্ট দুটি টিউবের প্রতিটির দৈর্ঘ্য দুই দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। গত বছরের ২৬ নভেম্বর টানেলের দক্ষিণ প্রান্তের একটি টিউবের পূর্তকাজের সমাপ্তি উদযাপন করা হয়েছে। এই উদযাপন অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এছাড়া মূল টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে পাঁচ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ফ্লাইওভার থাকবে।

২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল আট হাজার ৪৪৬ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা। পরবর্তীতে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১০ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক দুই শতাংশ সুদে পাঁচ হাজার ৯১৩ দশমিক ১৯ কোটি টাকা দিচ্ছে। বাকি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।