সব সংবাদস্পটলাইট

ফাঁসির দড়ি থেকে চার ধাপ দূরে দণ্ডিতরা

34নিষ্ঠুরতম উপায়ে শিশু হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামিকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলাতে এখনো চার ধাপ আইনি লড়াই বাকি। সিলেটে রাজন হত্যা এবং খুলনায় রাকিব হত্যা মামলার বিচার শেষ হয়েছে মাত্র চার মাসের মধ্যে। দুই মামলায় আলাদা বিচারে গত রবিবার ছয় আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট আদালতের একনিষ্ঠতা, পুলিশের তদন্ত কার্যক্রম ও সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের সহযোগিতায় নজিরবিহীনভাবে কম সময়ের মধ্যে বিচার শেষ হওয়ায় জনগণ ও বাদীপক্ষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও উচ্চ আদালতের বিচারপ্রক্রিয়ার ধাপগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। তবে দাবি উঠেছে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেন এসব মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়ে সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে রায় কার্যকর করে।

খুলনার শিশু রাকিবের খালা নাসরিন আক্তার, ছোট বোন রিমি আক্তার দুই আসামির ফাঁসির রায় দ্রুত কার্যকর করতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। একই দাবি জানিয়েছেন সিলেটের রাজনের মা-বাবাও। রাজনের বাবা শেখ আজিজুর রহমান বলেন, ‘রায়ে আমি সন্তুষ্ট। এখন একটাই দাবি, যেন দ্রুত এই রায় কার্যকর হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে হত্যার বিচারে গণমাধ্যম এবং সরকার যেভাবে বিশেষ উদ্যোগী ছিল, রায় কার্যকরের ক্ষেত্রেও সেভাবে উদ্যোগী হবে এমনটাই আশা করি।’

এমন দাবি পূরণ করতে হলে উচ্চতর আদালতের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুযায়ী বিচারিক আদালত ঘোষিত ফাঁসির রায় কার্যকর করতে হলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অনুমতি নিতে হয়। এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘দায়রা আদালত যখন মৃত্যুদণ্ড দান করেন, তখন হাইকোর্ট বিভাগে কার্যক্রম পেশ করবেন এবং হাইকোর্ট বিভাগ উহা অনুমোদন না করলে দণ্ড কার্যকর করা যাবে না।’

এ কারণে রায় ঘোষণার পর মামলার নথি হাইকোর্টের অনুমোদনের জন্য গতকাল সোমবারই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার হাইকোর্টের অনুমোদনের জন্য ‘ডেথ রেফারেন্স’ হিসেবে নথি হাইকোর্টে পাঠানোর পাশাপাশি আসামিপক্ষ ইচ্ছে করলে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে বলেও রায়ে বলা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪১৮ ধারা অনুযায়ী বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল করতে পারবে। কাজেই আসামিদের আপিল, ডেথ রেফারেন্স শুনানি হবে হাইকোর্টে। এর পরও শাস্তি বহাল থাকলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগেও আসামি পক্ষ ইচ্ছে করলে আপিল করতে পারবে। আপিল বিভাগও যদি দণ্ড বহাল রাখেন তারপর আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

কম্প্রেসার মেশিনের সাহায্যে মলদ্বার দিয়ে হাওয়া ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছিল শিশু রাকিব হাওলাদারকে। এ হত্যা মামলায় খুলনার দায়রা জজ দিলরুবা সুলতানা (ভারপ্রাপ্ত) আসামি মো. শরিফ ও মো. মিন্টু খানকে গত রবিবার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। আদালত আরেক আসামি শরিফের মা বিউটি বেগমকে বেকসুর খালাস দেন। অন্যদিকে একই দিনে সিলেটের শেখ সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলায় চারজনের ফাঁসি এবং ছয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

খুলনার রাকিব হত্যা মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী তৌহিদুর রহমান চৌধুরী তুষার বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই আমরা আপিল করব। একই সঙ্গে আসামিরা জেল আপিলও করবেন।’ অন্যদিকে বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা রায় পর্যালোচনা করছি। রায় ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেই আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।’ এই মামলার আসামি বিউটি বেগমকে খালাস দেওয়ার বিষয়েই তিনি এ কথা বলেন।

খুলনার মামলাসংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলেন, আইনের বিধান অনুযায়ী এই মামলাটি এখন হাইকোর্টে যাবে। নিম্ন আদালতের দেওয়া রায়ের ‘ডেথ রেফারেন্স’ এবং দণ্ডিতদের আপিল শুনানি শেষে রায় দেবেন উচ্চ আদালত। যদি উচ্চ আদালত বিচারিক আদালতের রায় বহাল রাখেন, তবে দণ্ডিতরা আপিল বিভাগে আপিল করার সুযোগ পাবে। সেখানে আসামিদের দণ্ড বহাল রাখলে তারা আবারও দণ্ড রিভিউ করার জন্য আবেদন করতে পারবে। রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে দণ্ডিত এবং ফাঁসির দড়ির মাঝে থাকবে শুধু রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন। রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন নিষ্পত্তি হলেই ফাঁসি কার্যকর হবে, যা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

সিলেটে নিহত রাজনের বাবার আইনজীবী এবং সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট এমাদউল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহিন কালের কণ্ঠকে বলেন, রায় কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রথমত মৃত্যুদণ্ডের রায়টি অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের অনুমোদন নিতে হবে। দ্বিতীয়ত আসামিপক্ষ যদি আপিল করে তবে সেটির নিষ্পত্তি হতে হবে। এরপর রায় বহাল থাকলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগেও আসামিরা আপিল করতে পারবে।

ফৌজদারি মামলায় অভিজ্ঞ এই আইনজীবী বলেন, ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চ যদি রায় অনুমোদন দেন তাহলে মামলার রেকর্ডপত্র আবার বিচারিক আদালতে চলে আসবে এবং বিচারিক আদালত মৃত্যু পরোয়ানা ইস্যু করবেন। বিচারের ক্ষেত্রে মামলাটি যেভাবে অগ্রাধিকার পেয়েছে সেভাবে যদি অগ্রাধিকার না পায় তাহলে ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চে শুনানিতেই বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তবে মামলাটি বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া হলে দুই-তিন মাসেই নিষ্পত্তি সম্ভব।

অন্যদিকে আসামিরা যদি আপিল করে তাহলেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রেও মামলাটি অগ্রাধিকার পাওয়ার ওপর নিষ্পত্তির সময় নির্ভর করবে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রায় ঘোষণার সাত দিনের মধ্যে এবং অন্য আসামিদের ৬০ দিনের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপিল করার বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে শুনানির জন্য দৈনন্দিন কার্যতালিকায় স্থান পাওয়ার বিষয়টি জড়িত। তবে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে যদি মামলাটিকে চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে বিশেষ অগ্রাধিকারের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে দ্রুত মামলাটি নিষ্পত্তি করা যেতে পারে বলে মনে করেন ওই আইনজীবী। তিনি বলেন, যদি হাইকোর্টে রায়টি বহাল থাকে তবে আসামিরা সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে পারবে। সে ক্ষেত্রেও একই সময় ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। অ্যাডভোকেট এমাদউল্লাহ শহিদুল ইসলাম মনে করেন, হাইকোর্টে রায় অনুমোদন থেকে শুরু করে আপিলের বিভিন্ন পর্যায়ে যদি মামলাটি বিচারিক আদালতের মতো অগ্রাধিকার পায় তাহলে এক বছরের মধ্যে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে রায় কার্যকর করা সম্ভব হবে। অন্যথায় কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।

সিলেট মহানগর জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট মফুর আলীও একই প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, আইনের ধাপগুলো তো অনুসরণ করতে হবে। এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে চাঞ্চল্যকর এই মামলার বিচার হয়েছে একইভাবে পরবর্তী প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

হাইকোর্টে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি হতে বাধা নেই : পিলখানা হত্যা মামলায় ১৫২ আসামির ফাঁসি, ৪১৮ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও বিভিন্ন মেয়াদে আরো অনেককে কারাদণ্ড দিয়ে ঢাকার একটি দায়রা আদালত রায় দেন ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। অল্পদিনের মধ্যে ২০১৪ সালেই এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিপক্ষের আপিলের শুনানি শুরু হয় হাইকোর্টে। বর্তমানে মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি চুড়ান্তভাবেই চলছে। পিলখানা হত্যা মামলাটিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সরকার এর আগের অনেক ডেথ রেফারেন্স শুনানির আগেই শুনানির ব্যবস্থা করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে শিশু নির্যাতনের হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সিলেট ও খুলনায় দুই শিশুকে হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়ায় তা দ্রুত কার্যকর করতে সরকারপক্ষ থেকে দুটি মামলাই হাইকোর্টে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির ব্যবস্থা করতে পারে। এতে আইনগত কোনো বাধা নেই বলে জানান আইনজীবীরা।

বিশিষ্ট আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের বিষয়ে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স শুনানির ব্যবস্থা দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। শিশু রাজন ও রাকিব হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড-সংক্রান্ত ডেথ রেফারেন্স জাতীয় ও আইনগত বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সে কারণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত শুনানির ব্যবস্থা নেওয়া হলে তা সংবিধান সম্মতও হবে। সংবিধানে বিচারপ্রার্থীদের বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির করার কথা বলা আছে।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.