পালদের পালনী মাস বৈশাখ
ঢাকা জার্নাল: আর মাত্র একদিন। তারপরই কাছ থেকে ছুটি। জীবিকার তাগিদ এক মাসের জন্য নির্বাসনে যাবে কালিয়াকৈরের পালপাড়া থেকে।
শুধু চাপাইরের এই পাড়ায় নয়, দেশের সব পালপাড়ায়ই এমন চিত্রই দেখা যাবে বৈশাখ জুড়ে।
চাক ঘুরবে না, মাটি আসবে না নৌকায় করে, ভোর চারটায় উঠে কেরোসিন বা মোমের বাতি জ্বলবে না উঠোনে। একমাস শুধুই অবসর। বছরের সব ক্লান্তি দূরে সরিয়ে রাখা, যেন উদ্যম সঞ্চয় সারা বছরের।
চাপাইরে প্রায় ৩৫টির মতো পরিবার জড়িত মৃৎশিল্পে। পালপাড়ায় ঢুকে দেখা গেল সবাই ব্যস্ত ভীষণ। কথা বলারই ফুরসত নেই যেন। কারণ এ মাস শেষেই তারা কাজ বন্ধ দেবে এক মাসের জন্য। বছরের সব ক্লান্তিকে ছুটি দিয়ে একটু অবসর, আনন্দ, উৎসব উদযাপন।
তবে তারা এমনিতেই কাজ বন্ধ দেয় না। এর পেছনে রয়েছে চিরায়ত বিশ্বাস, ঐতিহ্য, যা মিশে আছে পালবাড়ির দীর্ঘ ইতিহাসজুড়ে।
পাল পাড়ার প্রাচীন বয়সীদের মধ্যে বীনা পাল একজন। বয়স ষাটের উপর। দেখলে বোঝা যায় না। এখনো দাপিয়ে কাজ করে বেড়াচ্ছেন। সারা বছর এভাবে কাজ করতে ভালো লাগে? এমন প্রশ্ন করতেই তিনি বলেন, বৈশাক আমাগো পলনি মাস। সারা বছর কাম করি।
এটা শুনে আগ্রহ বাড়লো। বিস্তারিতজানতে চাইলাম।
এরপর তিনি শোনালেন তাদের পালনী মাসের কথা।
সারা বছর তারা কাজ করেন শুধু বৈশাখ মাস বাদে। চৈত্রসংক্রান্তির আগে তাদের মহাদেব সাজে। তারপর গাছ ঘুরানি হয় সংক্রান্তির দিন। মহাদেব সাতপাক ঘোরে আর পাড়ার সব মানুষ নেচে-গেয়ে আনন্দ করেন। নাচা শেষ হলে মন্দিরের মধ্যে মহাদেব বসিয়ে পূজা দিয়ে তাকে বিন্নি, খেলনা, দুধ, কলা দিয়ে সেবা করা হয়। চৈত্র মাসের সাত বা পনের দিন থাকতে দেল নামায়। মহাদেব বা শিবকে তারা দেল বলেন। দেল নাকি আবার নিমগাছের দেবতা। তারপর ঢাক ঢোল নিয়ে সারা পাড়া ঘুরে মহাদেব চাল, টাকা সংগ্রহ করেন।
মহাদেব কিন্তু একজনকে সাজানো হয়। সন্ন্যাসী সেজে যারা থাকেন তাদের আবার বৈশাখের ২ বা তিন তারিখে মাছমুখো করতে হয়।সন্ন্যাসীদের অবশ্যই মাছমুখো করতে হবে। এটা নিয়ম। আর যদি কেউ এটা না মানতে পারে এবং ওইসময় যদি পরিবারের কেউ মারা যায় তাহলে তারা আর কখনো মাছ খেতে পারবে না। মহাদেব সাতদিন ধরে নেচে, ঘুরে তারপর মাটিতে নামেন। মাটিতে তিনি থাকেন। কারণ মাটি ঠাণ্ডা। আর এ মাটিই পালদের জীবন-জীবিকা। তাই মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে তারা পক্ষান্তরে মাটি পবিত্র করেন। এ মাটি যেন তাদের মঙ্গল বয়ে আনে।
চৈত্র মাসের শেষ দিনও সবাই কাজ করে। সংক্রান্তির দিন মাটিতে মহাদেব গড় (গড়াগড়ি) দেন। একজন মহাদেব সাজেন। তিনি সন্ন্যাসী। চৈত্রের শেষ দিন এসে মন্দিরে বসেন মহাদেব। তখন তাকে সেবা করা হয়, হাত পা ধোয়ানো হয়, খাওয়ানো হয়। মহাদেবের আদলে তাকে সাজানো হয়। তারপর ঠিক মহাদেবকে যেভাবে শ্রদ্ধা ভক্তি দিয়ে পূজা, সেবা করা হয় তাকেও ঠিক একইভাবে সেবা করা হয়।
চাক পূজা
বৈশাখ মাসের শেষে জৈষ্ঠ্য মাসে চাক বসিয়ে পূজা করা হয়। চাক হলো কুমোরদের জীবিকার চাকা। চাক ঘুরিয়েই তারা খুব দ্রুত ও সহজে দ্রবাদি তৈরি করতে পারেন। তাই চাক তাদের কাছে পূজনীয়। চাক বসানোর জায়গাটা পরিষ্কার করে লেপন করে চাক বসানো হয়। চাকটাকে সাজিয়ে ব্রাহ্মণ এনে পূজা করা হয়।
তাপরপর প্রদীপ বা তাদের ভাষায় মইলকা বানানো হয়। মইলকার মধ্যে ধান-দুর্বা দিয়ে পূজা করে পরদিন নতুন কাজ শুরু করে টানা একমাসের বিরতি শেষে।
যুগ যুগ ধরে পূর্বপুরুষের বিশ্বাস অনুযায়ী এ প্রথা মেনে আসছেন তারা।