পদ্মার জলে হুমায়ূনের জ্যোৎস্না দেখা
এস এম আববাস:‘চান্নি পসর রাতে যেন আমার মরণ হয়’গানটি মনে করিয়ে দেয় পদ্মার জলে হুমায়ূনের জ্যোৎস্না দেখার সেই স্মৃতি। প্রত্যাশা মত হুমায়ূন আহমেদের চান্নি পসর (পূর্ণিমার) রাতে মৃত্যু হয়নি। কিন্তু চাঁদনি রাতে তিনি কেমন আপ্লুত হতেন, তা এক যুগেরও বেশি সময় আগে রাজশাহীর পদ্মা নদীর জল, জ্যোৎস্না আর তার সঙ্গীরা জেনেছেন। সেবার হুমায়ূনের সেই দলের সঙ্গে ভাগ্যগুণে ছিলাম জুটে গিয়েছিলাম আমিও।
১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসের প্রথমার্ধের কথা। মা ও শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারি কার্যক্রমের একটি প্রচারাভিযানে হুমায়ূন আহমেদ তখন রাজশাহীতে। এশিয়াটিক এটির আয়োজন করেছিল। টিভিতে প্রচারিত নাটক ‘সবুজ ছাতা’ জনপ্রিয় করতে নাটকের মূল কুশীলবদের নিয়ে রাজশাহীতে বিভাগীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিলো এটি। সঙ্গে কয়েকজন সংগীত শিল্পী এবং মডেলও ছিলেন ওই আয়োজনে। ছিলেন পরবর্তীতে তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনও।
এশিয়াটিকের আয়োজন শেষ। রাত প্রায় ১২টা। ঝলমলে জ্যোৎস্নায় ধূয়ে যাচ্ছে পদ্মার পাড়। এমনি মোহনীয় আবহে হুমায়ূন আহমেদ রাজশাহীর অখ্যাত এক চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ‘সান সি’র মালিক শাহীন আক্তারকে নিয়ে পদ্মার ধারে গেলেন। চাঁদের আলোয় পদ্মা নদীর জল দেখবেন বলে।
পদ্মার ধারে ‘টি’ বাঁধের পশ্চিমে ছোট্ট বটগাছের পুর্বদিকে বাঁধের ওপর বাদাম খাওয়ার আড্ডার ঢঙে বসলেন হুমায়ূন। সঙ্গে দু’জন মডেল আর এশিয়াটিকের অনুষ্ঠান তত্ত্বাবধায়ক হিন্দোল রায়। মডেল দু’জনের নাম জানার সুযোগ হয়নি। বাইরের লোক বলতে শাহীন আক্তার। তবে এসময় মেহের আফরোজ শাওন ছিলেন না তার সঙ্গে।
শাহীন আক্তারের কথায় “আমরা তার জীবন ও সাহিত্য নিয়ে কথা শুনতে আগ্রহ দেখাই। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ যেন তার স্বপ্নের জগতে চলে গেছেন। চাঁদনি রাত, ঝলমলে জ্যোৎস্না আর পদ্মার জলরাশি দেখার আনন্দে বিভোর, একাকার।
এসময় জল আর জ্যোৎস্না নিয়ে কয়েক লাইন লিখেও শোনালেন হুমায়ূন আহমেদ। আজ আর ওই লেখার কিছুই মনে নেই। শুধু স্মৃতি টুকু ঝকঝকে রয়ে গেছে মনের আয়নায়।”
এশিয়াটিকের হিন্দোল রায় সময়ের বিষয়টি ‘স্যার’কে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য শাহিন আক্তারকে এক ফাঁকে বলেন, “রাত পৌনে একটা।” শাহীন তখন হুমায়ূন আহমেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, “স্যার রাত পৌনে একটা।” তারপরেও আরো প্রায় পনের মিনিটেরও বেশি সময় আপন মনে একবার চাঁদ আর একবার পদ্মার জলে জ্যোৎস্না কিভাবে খেলা করে তা দেখলেন। এরপর গভীর রাতে পর্যটন মোটেলে ফিরলেন হুমায়ূন আহমেদ।
পদ্মাতীরের সৌন্দর্যের মতো তাকে সমান টেনেছে শহীদ কামারুজ্জামান (জাতীয় ৪ নেতার অন্যতম) কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানার পশু-পাখি।
দু’দিন ধরে ক্লান্তিহীন হুমায়ূন আহমেদ। একদিন সকালে উঠেই বেরুলেন। সঙ্গে বিশিষ্ট নাট্য শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর (বর্তমানে সংসদ সদস্য), মেহের আফরোজ শাওন (তখন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে শাওনের বিয়ে হয়নি)। হুমায়ূন ও আসাদুজ্জামান নূরের এই দলটির তত্ত্বাবধানে পরদিনও ছিলেন হিন্দোল রায়।
হুমায়ূন আহমেদের বিচিত্র এই ভালোলাগাকে প্রাধান্য দিতে সেদিন কার্পণ্য করেননি নূর ও শাওন।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মিজানুর রহমান মিনু নিজে তাদের ঘুরে ঘুরে দেখাবেন শহীদ কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানা (ওই সময় এটির নাম ছিল রাজশাহী কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানা)।
রাজশাহী থিয়েটারের কর্মীদের সঙ্গে দেখা করতে এবং তাদের খোঁজ-খবর নিতে সারা যাকের আলাদাভাবে সময় কাটাচ্ছেন রাজশাহীতে। আলী যাকেরও চলে গেছেন ব্যস্ততা নিয়ে। অনুষ্ঠান শেষে শাকিলা জাফর ও রিজিয়া পারভীনসহ অন্যরাও ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছেন।
হুমায়ূন আহমেদ রাজশাহীতে পুরো একটি বেলা কাটালেন কেন্দ্রীয় উদ্যানের গাছপালা ও পশুপাখি দেখার জন্য।
মেয়র মিনুর আসতে দেরি হচ্ছে। অপেক্ষা করে সময় নষ্ট করেননি হুমায়ূন আহমেদ। পার্কে ঢুকেই জানতে চাইলেন কি কি পশু-পাখি রয়েছে। হরিণের প্রসঙ্গ আসতেই হরিণ দেখার জন্য কৌতুহলী হয়ে উঠেন। তার সঙ্গে হরিণের ডেরায় চলে যান সবাই। হরিণ দেখে ফিরতেই পেছন ফিরে দেখা গেলো হুমায়ূন আহমেদ দলে নেই। থমকে দাঁড়ালেন শাওন। হুমায়ূন আহমেদ না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল। পার্কের ভেতরে রাস্তায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে গেলেন সবাই।
আসাদুজ্জামন নূরকে লক্ষ্য করে হিন্দোল রায় বললেন “স্যার চলে আসবেন, আমরা হাঁটতে থাকি।” শাওন বললেন ‘না, আসুক।” দাঁড়িয়ে গেলেন নূর। আমরা সবাই সেখানে দাঁড়ানোর বেশ খানিকটা পরে হুমায়ূন আহমেদ এসে পৌঁছুলেন। ইতোমধ্যে মেয়রও এসে গেছেন।
পরে জানা গেলো হুমায়ূন আহমেদ পার্কের পশ্চিম ধারের গাছগুলো দেখছিলেন আপন মনে। ভক্তদের একজন বললেন, “স্যার পশ্চিম দিকে লেকের ধারে গাছের সঙ্গে কথা বলছিলেন।” হুমায়ূন ভক্তের এ কথাটির ওই সময় কোনো গুরুত্বই দেয়নি কেউ।
এরপর ময়ূর দেখতে হুমায়ূন আহমেদ বেশ খানিটকা সময় কাটালেন। আকাশে সাদা মেঘ। মেঘ দেখলে নাকি ময়ূর পেখম মেলে। কথাগুলো বলাবলি চলছিলো। এমন সময় সত্যি সত্যিই ময়ূর পেখম মেলে দিল। অনেকেই এ দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করলেন। মনে হচ্ছিল শিল্পীদের দেখে ময়ূর তার সৌন্দর্য তুলে ধরলো যেন। হুমায়ূন ময়ূর দেখার পর বাঘ ও বানরসহ সব পশু-পাখি আর গাছপালা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন নিরবে।
ছোট ছোট আনন্দ, দুঃখ-কষ্টগুলোও ফুটিয়ে তুলে পাঠক-দর্শকদের যতটা আনন্দ দিতেন তিনি। নিরবে গাছ, পশু-পাখি আর জলের রং-রূপ দেখে তিনি নিজে তার চেয়ে বেশি আনন্দ পেতেন। তা কাছ থেকে দেখে উপলদ্ধি না করলে কাউকে বোঝানো যাবে না।
এখন অনুভব হচ্ছে গাছ-ফুল আর পাখির সঙ্গে মিতালী করতেই হুমায়ূন ‘নুহাশ পল্লী’ গড়ে তুলেছিলেন মনের মাধুরি মিশিয়ে।
সেবার রাজশাহীবাসীর ভালোবাসায় সিক্ত শিল্পীদের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ,আশাদুজ্জামান নূর ও শাওন ফিরেছেন সবার পরে। এটি রাজশাহীর হুমায়ূন ভক্তদের পক্ষে যেন একটু বেশিই পাওয়া। আর তাছাড়া সাধারণ মানুষের সাথে হুমায়ূন আহমেদের মিশে যাওয়াটাই ছিলো সেই দিনগুলোর অমর স্মৃতি।
এক যুগ পরে আজো চাঁদনি রাতে পদ্মার জলে জ্যোৎস্না খেলা করে। কিন্তু হুমায়ূন নেই। শুধু রয়ে গেছে পদ্মার তীরের কিছু স্মৃতি।
এস এম আববাস,বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
জুলাই ২৪, ২০১২