Leadসব সংবাদ

নির্বাচনি ডামাডোলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গোপন মিশন!

ঢাকা জার্নাল: জাতীয় নির্বাচনের ঢামাডোলে রুটিন কাজ সম্পন্নকারি সরকারের মন্ত্রীরা যখন ব্যস্ত সেই সময়টিতে গোপন মিশন বাস্তবায়নে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে উঠেছেন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কতিপয় কর্রামকর্তা। জনপ্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও গ্রেড উন্নীতকরণ সংক্রান্ত ফাইলগুলোর তড়িঘড়ি অনুমোদনের লক্ষ্যে কাজ করছেন তারা। দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) অনুমোদন এমনকি প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে ফাইল পৌঁছানোর দায়িত্বও তারা পালন করছেন বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে। এক্ষেত্রে দুনীর্তি দমন কমিশন (দুদক) এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সেগুলোকে সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে ফাইল অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের টেবিলে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আমলাদের সুপারিশ করা এমন একটি গোপনীয় ফাইল থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলামের গ্রেড উন্নীতকরণে এএসবি’র অনুমোদনের জন্য ফাইলটি পাঠানো হয়। বিষয়টিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের অনুমতি রয়েছে বলেও ফাইলে উল্লেখ করা হয়েছে।
নির্বাচনকালীন সময়ে পদোন্নতি কিংবা গেড উন্নীতের ফাইলে অনুমোদনের সুপারিশের ক্ষেত্রে নির্বাচনী আইনে কোনো বিধি নিষেধ না থাকলেও এটি নৈতিকভাবে সমিচিন নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এসব ক্ষেত্রে সরকারের সর্বোচ্চ পদধারীর সম্পৃক্ততা থাকে। ফাইল চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিতে হয়। আর প্রধানমন্ত্রী যেহেতু এখন নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ থেকে বিরত থাকছেন সেহেতু এসব ফাইল তার কাছে এখন না পাঠানোটাই যুক্তিযুক্ত। কেউ কেউ আবার বলছেন, জেনে বুঝেই এই সময়ে ফাইল নিয়ে কলকাটি নাড়ছেন আমলারা। সবাই এখন নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকায় ফাইল অনুমোদন করিয়ে নেয়াটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। যেকারণে এই সময়টিকেই তারা বেছে নিয়েছেন। তবে এবিষয়ে অভিযুক্ত আমলাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
নিয়মানুযায়ী, গ্রেড-২ থেকে গ্রেড-১ এ পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রধান প্রকৌশলী পদে চাকরির আগের এক বছর এবং বর্তমান পদে চাকরির বিগত তিন মাসের এসিআর জমাদান বাধ্যতামূলক। এছাড়া পদোন্নতির জন্য আবেদন করা প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ আছে কিনা তা জানাতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হালনাগাদ প্রতিবেদন, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার (এনএসআই), ডিজিএফআই/এসবি’র প্রতিবেদন থাকাটাও জরুরি। কিন্তু গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলামের এসএসবি সংক্রান্ত আবেদনে এসব কিছুর হালনাগাদ তথ্য নেই বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদন তো একেবারেই নেই। ফাইলে দাখিল করা দুদকের প্রতিবেনটিও ২০১৭ সালের। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কিছু কর্মকর্তা এসব বিষয় গোপন করে তার এসএসবি ফাইলটি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন। অপেক্ষা এসএসবি’র অনুমোদনের। এটি হয়ে গেলে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোসা. সুরাইয়া বেগম স্বাক্ষরিত গত ১১ ডিসেম্বর করা সুপারিশে বলা হয়েছে, বিসিএস গণপূর্ত ক্যাডারের প্রধান প্রকৌশলী (গ্রেড-১) পদে পদোন্নতির প্রস্তাব সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের সভায় বিবেচনার জন্য সার সংক্ষেপের ১২ সেট এতদসঙ্গে প্রেরণ করা হলো। প্রস্তাবটি সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের পরবর্তী সভায় উপস্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে সবিনয় অনুরোধ করা হলো। একই তারিখে দেওয়া একটি প্রত্যয়নপত্রে সুরাইয়া বেগম উল্লেখ করেন, এ মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা শাখা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী বিসিএস গণপূর্ত ক্যাডারের প্রধান প্রকৌশলী পদে কর্মরত মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় মামলা নেই বা প্রক্রিয়াধীন নেই। অপর একটি প্রতয়নে তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ অনুসন্ধানাধীন বা মামলা তদন্তনাধীন নেই। এর সঙ্গে তিনি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখা-৫ এবং দুদক থেকে দেওয়া আলাদা দুটি কাগজও সংযুক্ত করে দেন। বিভাগীর মামলা সংক্রান্ত কাগজটি চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর নেওয়া হলেও দুদকের প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে গত বছরের (২০১৭ সাল) ১৩ ফেব্রুয়ারি তারিখের। অর্থাৎ দুদকের হালনাগাদ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি। অথচ চলতি বছরেই মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছে, যেটি এখন তদন্তনাধীন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে পদোন্নতির সুপারিশ করে রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা বা দুদকে কোনো মামলা নেই বলে ফাইলে সার্টিফাই করেছেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব মো. শহীদুল্লাহ খন্দকারও। সার সংক্ষেপে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর সম্মতি রয়েছে জানিয়ে তাকে গ্রেড-১ পদে পদোন্নতির প্রস্তাব বিবেচনার জন্য এসএসবিকে সুপারিশ করেছেন।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের আওতাধীন দপ্তর/সংস্থা/কর্পোরেশনের প্রধানের পদকে গ্রেড-১ এবং গ্রেড-২ এ উন্নীতকরণ সংক্রান্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত পদগুলোর মধ্যে ৩০টি পদকে গ্রেড-১ এবং ২০টি পদকে গ্রেড-২ এ উন্নীত করার কথা বলা রয়েছে। ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি করা এ প্রস্তাবনাটি এতোদিন ফাইলবন্দী হয়ে পড়ে থাকলেও গত বছরের ৭ নভেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর পদটিকে গ্রেড-১ এ উন্নীত করে পরিপত্র জারি করে। এরপর পরই সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম নিজের গ্রেড উন্নয়নের জন্য তদবির শুরু করেন। কিন্তু এতে বাঁধ সাধে বিধি। কারণ তিনি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী থাকাকালীন গ্রেড-৩ এর কর্মকর্তা ছিলেন। প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার পর নানাভাবে তদবিরের মাধ্যমে চলতি বছরের ৩১ জুলাই তিনি গ্রেড-২ এ উন্নীত হন। এখন চলছে গ্রেড-১ এ উন্নীত হওয়ার তদবির।
এভাবে বিধিভঙ্গ করে তড়িঘড়ি করে বিশেষ একজন কর্মকর্তাকে এভাবে পদোন্নতি দেওয়ার তৎপরতা ভালো চোখে দেখছেন না পূর্ত সংশ্লিষ্টরা। তারা জানিয়েছেন, গ্রেড-৩ এর একজন কর্মকর্তাকে এতো দ্রুততার সঙ্গে ডাবল প্রমোশন দিয়ে গ্রেড-১ এ উন্নীত করা সমীচীন হবে না। তাছাড়া ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদের বেশ কয়েকটি স্থায়ী কমিটি ও দুর্নীতি দমন কমিশনে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এরপরও তাকে কেন পদোন্নতি দেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা উচিত।

ঢাকা জার্নাল, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৮।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.