নারীর ওপর মানসিক নির্ভরতা নয়
মাসকাওয়াথ আহসান || সম্প্রতি নারী সমাজের কিছু সাহসী উচ্চারণ সম্বলিত লেখালেখি চোখে পড়েছে। নারীর নীরবতা ভেঙ্গে প্রতিবাদী হওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে লেখাগুলোতে সাধারণীকরণ বা জেনারালাইজেশানের প্রবণতা চোখে পড়েছে। বাঙালি পুরুষের যে চরিত্র চিত্রণের প্রবণতা দৃশ্যমান; সেটিকে খুব নৈর্ব্যক্তিক মনে হয়নি।
নৈর্ব্যক্তিক সমালোচনায় কিছু নারী বা কিছু পুরুষ শব্দবন্ধ ব্যবহার জরুরি; কারণ সমাজের সব নারী বা সব পুরুষ গতানুগতিক আচরণ করেন না। যারা করেন তাদের সমালোচনা সুনির্দিষ্টভাবে করা যৌক্তিক। নইলে সমালোচনা আর ঢিল ছোড়ার মাঝে কোনো পার্থক্য থাকে না।
বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক পুরুষের প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে তারা নারীকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ফেলে। নারীর সঙ্গে কথা বলার অতি আগ্রহ প্রদর্শন বা প্রেম করার চেষ্টা করা দক্ষিণ এশিয়ার পুরুষ সমাজের আজকের এই সমালোচিত হবার মূল কারণ।
এক্ষেত্রে কবি-গীতিকার-কথাশিল্পী-চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখকদের একটি বড় দায় রয়েছে।ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্প-সাহিত্যে প্রেমের আকুতি এই সমাজটির জন্য কাল হয়েছে।পুরুষেরা নারীকে অজস্র অবাস্তব বিশেষণ দিয়ে অবিরাম কেঁদে চলেছে প্রেমিকার জন্য; অথচ বেশীরভাগ নারী কবি-গীতিকার-কথাশিল্পী-চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখকদের লেখায় এতো বিশেষণ বা কান্না দেখিনি। যা দেখেছি তা পুরুষ বিদ্বেষ বা পুরুষের সব কিছুই ভুল এমন অনুসিদ্ধান্ত টানা তিক্ততা।
ছেলে শিশুদের লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত করে ফেললে তাদের মাঝে নিঃসন্দেহে এই প্রেমের বাতিক কমে আসবে। মেয়েদেরকে জীবনে এতো গুরুত্ব দিয়ে উলটো দুর্নামের স্বীকার হওয়া অপ্রয়োজনীয়। জীবনে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ রয়েছে। যে বিপুল সংখ্যক দক্ষিণ এশীয় পুরুষ ব্যর্থ প্রেমিক হয়ে নিজের জীবন অপচয় করেছে; তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আজ শিক্ষা-গবেষণা-শিল্প-সংস্কৃতিতে এইসব জনপদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ এই প্রেম রোগ।
যে ছেলেটি পড়ালেখা বাদ দিয়ে পাড়ার কিশোরীকে নিয়ে ভাবছে; সে পড়ালেখাটা ভালো করে করলেই কিন্তু তার ঐ মহল্লার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে বৃহত্তর সমাজে প্রবেশ করতে পারে; এমনকী বিশ্বসমাজেও।
অনগ্রসর সমাজ সৃজনশীল মানুষের গুরুত্ব বোঝে না। অনগ্রসর সমাজের একজন নারীর চিন্তার জগত স্বভাবতই সীমাবদ্ধ হয়। সে অনুসরণ করে সমাজের এঁকে দেয়া সাফল্যের মানদণ্ড। বিজ্ঞাপনের আদলে সাজানো ঘর-দোর; বাহিরী চটক তার জীবনের লক্ষ্য হয়। চিন্তাভাবনা খুবই অর্থনীতি নির্ভর হয়। কিন্তু জীবনের গভীরের জীবনকে বুঝতে গেলে যে আগে স্বাবলম্বী হতে হয়। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার কিছু নারী নিজেকে কেবল প্রস্তুত করে একটি বিয়ের জন্য। বিয়ে হওয়া মানেই স্বামীর উপার্জনে “বেগম সাহেবা” সেজে শো-অফ করে বেড়ানোটাই তাদের জীবনের চূড়ান্ত সাফল্য। ব্যতিক্রমী নারী অবশ্যই রয়েছেন; যারা স্বাবলম্বী। এরা খুবই জেনেরিক আঙ্গিকে পুরুষ সমাজ সম্পর্কে সুইপিং কমেন্টও করেন।
দক্ষিণ এশীয় পুরুষ সমাজ এখানকার নারী সমাজ কর্তৃক যে মানসিক নির্যাতনের স্বীকার হয়; তা অদৃশ্য; ফলে প্রতিদিন অসংখ্য পুরুষের মানসিক হত্যা চলে আদিম কূট-কৌশলে। বেশীরভাগ পুরুষই নারীদের মতো বাকপটু হয় না। ফলে হয় নীরবে সহ্য করে বা একদিন ধারাবাহিক মানসিক অত্যাচারে সহিংস হয়ে ওঠে। এই জায়গাটিতে পুরুষ সমাজকে খুবই সচেতন হতে হবে। কোনভাবেই কোন সহিংসতায় জড়াতে নেই। সহিংসতার কোনো ক্ষমা নেই। ক্ষমা নেই মানসিক হত্যারও। দক্ষিণ এশিয়া গ্রাম্য সমাজ বলে এখানে মানসিক নির্যাতনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার চল নেই।
তাই দক্ষিণ এশীয় পুরুষ সমাজকে ‘না’ বলতে শিখতে হবে; নিজেকেও ‘না’ শুনতে অভ্যস্ত করতে হবে। তাকে মানসিক নির্যাতনের ইতি ঘটাতে হবে অত্যন্ত ঋজুতার সঙ্গে। সে ক্ষেত্রে নারীর ওপর মানসিক নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। ঋজুতার সঙ্গে খুবই ভদ্রভাবে তিক্ত যে কোনো সম্পর্কচ্ছেদ ঘটাতে শিখতে হবে। পশ্চিমা সমাজের পুরুষেরা এটা অনেক আগে শিখেছিলো বলেই এতোগুলো নোবেল পুরস্কার ওদের ঘরে।
দক্ষিণ এশীয় পুরুষ সমাজকে গৃহব্যবস্থাপনা শিখতে হবে। আত্মনির্ভর উন্নয়ন কৌশল অর্জনের জন্য রান্না-ঘর গোছানো এগুলো অবশ্যই শিখতে হবে। নারীকে কোন ক্ষেত্রেই “লিখে রেখো এক ফোটা দিলেম শিশির” বলার সুযোগ দেয়া যাবে না।
নারীকে পারসন ভেবে তার সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে আচরণ করতে হবে। যে কোন পরিসরে একজন নারী এলেই বিগলিত হয়ে যাওয়া বা অশালীন আচরণ করা দুটোই পরিত্যাজ্য। এক্ষেত্রে পেশাদার নারী সমাজের কর্তব্য নারী হিসেবে বিশেষ কোন সুযোগ সুবিধা আর প্রত্যাশা না করা। “লেডিজ ফার্স্ট” এই যে সংস্কৃতিটি সবক্ষেত্রেই প্রচলিত এটা বিলোপ করেই কেবল সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
আমরা প্রত্যাশা রাখি নারীর সমস্যা সম্পর্কে লেখালেখি করা লিখিয়েরা সাধারণীকরণ (স্টেরিওটাইপিং) থেকে বেরিয়ে এসে নৈর্ব্যক্তিকভাবে লেখালেখি করবেন। তাদের যৌক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক প্রতিবাদের মাঝ দিয়ে নবজাগরণ সূচিত হোক; এ আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।
লেখক: সাংবাদিক।