Leadমত-অমতসব সংবাদ

নারীবাদ ও সমান অধিকার কি এক?

শেখ মঞ্জুরুল ইসলাম || ফেমিনিজম বা নারীবাদী শব্দটি অনেকেই অপব্যবহার করেন। আমার ধারণা না জেনেই করেন।  একটা সময় নারীরা ভোট দিতে পারতো না। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, চাকরি এমনকি সামাজিক অনেক কাজেই অংশ নিতে পারতো না। এই না পারার কারণে একটা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সেই আন্দোলনের ফলে অনেক দেশেই সফলতা এসেছে আর অনেক দেশেই এখন সফল হচ্ছে।

একটা উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হয়। আমেরিকায় নারীরা ভোটাধিকার পেয়েছেন ১৯২০ সালে। সেঞ্চুরি এখনো পূর্ণ হয়নি। অনেক আন্দোলনের মধ্যদিয়ে সেখানে নারীরা এই অধিকার আদায় করতে পেরেছেন। আর সৌদি আরবের নারীরা এই অধিকার পেয়েছেন মাত্র দুই বছর আগে ২০১৫ সালে। সুতরাং বলা যায়— এই আন্দোলন এখনো বর্তমান। আফ্রিকার জঙ্গলে যে উপজাতিদের বসবাস, যারা মানব সৃষ্ট আধুনিক সভ্যতার ধরা ছোঁয়ার বাইরে, তাদের সমাজেও এই আন্দোলন হতে পারে।  নারীবাদ কখনো পুরুষদের বিরুদ্ধে না বরং তাদের যৌক্তিক অধিকারের একটি আন্দোলন, যা কখনো পুরুষ বিদ্বেষকে প্রমোট করে না। শুধু মাত্র নারীই নারীবাদী হবে এমন কিন্তু না। অনেক পুরুষ আছেন যারা নারীবাদের পক্ষে এবং নারীদের অধিকার নিয়ে সচেতন ও সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগী।

আমরা প্রায়ই ভুল করে নারীবাদ আর লিঙ্গ বৈষম্যকে এক করে ফেলি। নারীবাদ আর লিঙ্গ বৈষম্যকে এক করে দেখা উচিত হবে না। আমাদের দেশে অধিকাংশ নারী লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার। নারীবাদীরা যে আন্দোলনে তাদের ফিলোসফি দাঁড় করিয়েছেন, সেদিক দিয়ে আমাদের দেশ অনেকাংশে পরিপূর্ণ। লিঙ্গ বৈষম্য একটি মানসিক ফেনমেনন। মিনা আর রাজুর একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। মিনার মা মিনাকে ডিম খেতে দেয় একটি, আর রাজুকে দু’টি। দাদি একটি আমের তিন ভাগের এক অংশ মিনাকে আর দুই অংশ রাজুকে দেয়। মেয়েদের বেশি পড়িয়ে কী লাভ! কয়দিন পরতো বিয়ে দিয়ে দিতে হবে! এই যে ছেলেদের পড়াশোনা করানো লাভজনক বিনিয়োগ আর মেয়েদের পড়াশোনা করানো অলাভজনক বিনিয়োগ, মানুষের এই ধারণাগুলো লিঙ্গবৈষম্য। লিঙ্গবৈষম্য অজ্ঞতা আর সচেতনতার অভাবে সৃষ্টি। কিন্তু নারীবাদী আন্দোলন অতীত থেকে বর্তমানে চলে আসা প্রথাগত পরিবর্তনের মতবাদ।

অনেকে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেন। কেও কেও বলেন— আমি দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করি, মেয়েরাও দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করুক! এমন মন্তব্য অসুস্থ বিকৃত মস্তিষ্ক থেকেই আসতে পারে। আমরা বরং তাদের সুস্থতা কামনা করি। ইংরেজিতে দুটো শব্দ— Equality এবং Equity প্রথমটির অর্থ সমান আর দ্বিতীয়টির অর্থ ন্যায়। বিষয়টি আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য নিচের ছবিটি দেখলে পরিস্কার হবে।  তারপরেও একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ৪৫ ধারা অনুযায়ী, অন্তঃসত্ত্বা শ্রমিক, সন্তান প্রসবের আগে আট সপ্তাহ এবং প্রসবের পরের আট সপ্তাহ, মোট ১৬ সপ্তাহ পূর্ণমজুরিতে ছুটি পাওয়ার অধিকার রাখেন। মালিক এই ছুটি দিতে বাধ্য। চাকরিতে এ ছুটি ভোগ করা যাবে সর্বোচ্চ দু’বার। এবং একটি নির্দিষ্ট হারে তার নিয়োগকর্তা কর্তৃক আর্থিক ভাতা পাবেন। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে সরকার সার্ভিস রুল সংশোধন করে সরকারি নারী কর্মকর্তাদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করেছে। তবে এই বিধান কেবল সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য। এখন কোনো পুরুষ যদি দাবি করে বসেন— আমিও এই সুবিধা ভোগ করতে চাই, তাহলে সেই দাবি কি অযৌক্তিক হবে না? কিছু অধিকার আছে প্রকৃতিগত, এ বিষয়ে তো কারো দ্বীমত থাকতে পারে না। বর্তমানে ভারতের কিছু রাজ্যে মেয়েদের পিরিয়ড লিভ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। অত্যন্ত যৌক্তিক। এখন অধিকারের আওতায় কোনো পুরুষ তো আসতে পারে না। সমান অধিকার শব্দটি অনেকের মাঝে সংশয় সৃষ্টি করে, যা বিতর্কের জন্ম দেয়। ভাষাবিদদের কাছে দাবি থাকলো নতুন কোনো শব্দ সৃষ্টি করার। নারী-পুরুষের অধিকারটা ইকুইলিটির না, অধিকারটা হচ্ছে ইকুইটির? তবে সব মানুষের অধিকার সমান।

বর্তমান সময়ে সদ্য বড় হয়ে ওঠা অধিকাংশ মেয়ে এই বিষয়গুলোকে গুলিয়ে ফেলছে। মা-বাবা যদি তাদের মেয়েকে বলে— তুমি মেয়ে মানুষ একা বাইরে যেওনা বা রাতে বের হইও না, তাহলে তারা নিজেদের অহংবোধকে প্রাধান্য দিয়ে মা-বাবার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। ব্যাপারটা এমন, তারা পরাধীন স্বাধীনতা চায়, তাই বিদ্রোহ করা। একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝানো যাক। ধরে নেই— বাড়িগুলো জীবন্ত (মনে করতে দোষ নেই) এখন তারা আন্দোলন করে বসলো মালিক পক্ষ আমাদের গেইটে বা দরজায় তালা দিতে পারবে না! আমরা বন্দি অনুভব করি! এটা কি যৌক্তিক হবে? মালিক পক্ষ চোর ডাকাতের ভয়ে তালা লাগায়, মনের সুখে অবশ্যই না।

এখন মা-বাবা অথবা অভিভাবক যদি রেইপ হওয়ার ভয়ে, দুশ্চিন্তার না বাড়ানোর কারণে, কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য এবং নিজেরা চিন্তামুক্ত ও নির্ভয়ে থাকার জন্য তাদের মেয়েকে একা যেতে নিষেধ করেন, কোনো বিশেষ কাজ করা থেকে বিরত রাখেন, সেটা কোখনো কন্যাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হবে না। বরং এটি পূর্বপ্রস্তুতিমূলক সতর্কতা। মা-বাবা বিশ্বাস করেন তাদের মেয়ে একা অনেক কাজ করার সামর্থ্য রাখে, কিন্তু বাইরের মানুষরূপী অমানুষগুলোকে বিশ্বাস করেন না। তাই তাদের যত ভয়। এই মমত্ববোধের সঙ্গে নারীবাদ, লিঙ্গ বৈষম্য, সমান অধিকার অথবা স্বাধীনতা-পরাধীনতার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।

লেখক, শেখ মঞ্জুরুল ইসলাম

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ এর শিক্ষার্থী।

ঢাকা জার্নাল, ৩০ আগস্ট, ২০১৬।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.