Leadসংবাদ শিরোনামসব সংবাদ

নতুন ভূমি ঘিরে উন্নয়ন স্বপ্ন

01চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ভোলা, খুলনাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন নদীর মোহনায় সাগরের বুক চিরে জেগে উঠছে নতুন নতুন ভূখণ্ড। আর সাগর থেকে ভূমি উদ্ধার ত্বরান্বিত করতে নেদারল্যান্ডস ও আইএফএডির সহায়তায় সমন্বিতভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ। এমন সমন্বিত কার্যক্রমের ফলে প্রতিবছর গড়ে অন্তত ২০ বর্গকিলোমিটার নতুন চরের দেখা মিলছে। তবে নদী ও সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে ব্যাপক ভাঙনের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে গড়ে এর আট বর্গকিলোমিটার। ভাঙাগড়ার এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই গত চার দশকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যুক্ত হয়েছে অন্তত ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার বা ১০ লাখ হেক্টর নতুন ভূমি। এর মধ্যে কক্সবাজারের মহেশখালীতে জেগে ওঠা প্রায় ৫০ হাজার একর ভূমি ঘিরে উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে। জানা গেছে, মহেশখালীর ওই চরে একই স্থানে এক মন্ত্রণালয় চায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে, আবার আরেক মন্ত্রণালয় আগ্রহী গভীর সমুদ্রবন্দর বানাতে। একই জায়গার মালিকানা চাইছে দুই মন্ত্রণালয়। কেউ কাউকে চুল পরিমাণ জমি ছাড় দিতে নারাজ। মন্ত্রণালয়গুলো নিজেদের মধ্যে সমন্বয় না করে এভাবে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করায় দেখা দিয়েছে জটিলতা।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহেশখালীতে সাগর থেকে জেগে ওঠা ভূমিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহী। জাইকার অর্থায়নে মাতারবাড়ী বিদ্যুেকন্দ্রের আওতায় মহেশখালীতে আলাদা একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চায় বিদ্যুৎ বিভাগ। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে তোড়জোড় শুরু করেছে। জেগে ওঠা চরে একটি পর্যটন অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। সড়ক পরিবহন ও  সেতু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, সড়ক ছাড়া সব পরিকল্পনাই অচল। সড়ক না থাকলে মানুষের চলাচল ও পণ্য পরিবহন করা যাবে না। তাই সেখানে সড়ক নির্মাণের বিকল্প নেই। রেলপথ মন্ত্রণালয়ও পিছিয়ে নেই। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মহেশখালীর সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপন করা জরুরি। অন্যদিকে জেগে ওঠা ভূমিতে এলএনজি টার্মিনাল করতে চায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয়গুলো জমি ব্যবহারে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তাতে দ্বৈততা রয়েছে। অতিদ্রুত এই দ্বৈততা দূর করা প্রয়োজন। মহেশখালীর জমি ব্যবহারে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় জরুরি বলেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে বিদ্যমান জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে গত ৫ জানুয়ারি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ।

বৈঠকে তিনি প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় জমির সুনির্দিষ্ট পরিমাণ জানতে চান মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের কাছে। কিন্তু কোনো মন্ত্রণালয় সে হিসাব দিতে পারেনি। বৈঠকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় যোগযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে তাদের কর্মপরিকল্পনাও দিতে পারেনি। এমনকি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বনভূমি ও পর্যটন এলাকার জন্য সুনির্দিষ্ট জমির পরিমাণ চূড়ান্ত করতে পারেননি। চাহিদার আলোকে জমির সুনির্দিষ্ট পরিমাণ ও কর্মপরিকল্পনা দিতে না পারায় ক্ষুব্ধ হন মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ। ওই সময় তিনি মন্ত্রণালয়গুলোকে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে আরো এক মাস সময় দেন; যদিও এর আগে মন্ত্রণালয়গুলোকে দুই মাস সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে সময়ের মধ্যে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে পারেনি কোনো মন্ত্রণালয়। এদিকে কক্সবাজারের মহেশখালীতে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে পরিবেশের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে পরামর্শ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

মহেশখালীর নতুন ভূমির ব্যবহার পরিকল্পনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (এক) শেখ ইউসুফ হারুনের সভাপতিত্বে গঠিত কমিটি এ পরামর্শ দেয়। গত ২২ অক্টোবর মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন শেষে কমিটি তার প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দেশের সার্বিক উন্নয়নে মহেশখালীতে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ জরুরি। একই সঙ্গে সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করতে গিয়ে পরিবেশের বিষয়টিও বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া উচিত। কারণ সোনাদিয়া এলাকায় ইসিএ হিসাবে ঘোষণা দেওয়া রয়েছে। কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত এক কর্মকর্তা  জানান, মহেশখালীর পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য ধারণ করে আছে। সেখানে তিন প্রজাতির কচ্ছপ আছে, যেগুলো আইইউসিএনের ‘ক্রিটিক্যালি এনডেনজারড’ তালিকাভুক্ত। একই সঙ্গে মহেশখালীতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ভূমি উন্নয়নের জন্য মাটি সংগ্রহ করতে গিয়ে কিংবা অন্য কোনোভাবে দ্বীপের পাশ দিয়ে প্রবাহমান গভীর চ্যানেল যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটি নিশ্চিত করতে মন্ত্রণালয়গুলোকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

মহেশখালী ঘিরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানা যায়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সেখানে এসপিএম ট্যাংক ফার্ম নির্মাণের জন্য ৩৩ একর জমি চেয়েছে। পাশাপাশি কুয়েত পেট্রোলিয়াম কমপ্লেক্স নির্মাণ করার জন্য এক হাজার একর, মহেশখালী-আনোয়ারা গ্যাস পাইপ প্রকল্পের জন্য ১৪ একর এবং এলএনজি টার্মিনালের জন্য ৭০০ একর জমি চাওয়া হয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সেখানে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য ছয় হাজার হেক্টর জমি চেয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের জন্য সেখানে আলাদা একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য জমি চেয়েছে এক হাজার ৬৫০ একর। এ ছাড়া সিঙ্গাপুরের সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করতে এক হাজার ২০০ একর জমি চাওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে মহেশখালীতে ১১ হাজার ৫৫০ একর জমি বরাদ্দ দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে এসব হিসাব সাময়িক। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বেশ জটিল। এ দ্বীপে একদিকে যেমন আছে পাহাড়ি এলাকা, অন্যদিকে বালিয়াড়ি। চারদিকে উপকূলীয় সমতলভূমি। ওই অঞ্চলের কিছু অংশ জোয়ারে নিমজ্জিত হয় এবং পলি সঞ্চিত হচ্ছে। এ ছাড়া আছে অসংখ্য ছোট-বড় খাঁড়ি (খাল)। ফলে যথাযথ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া ভূমি ব্যবহার করলে তা পুরো দ্বীপের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহেশখালী এলাকায় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে অন্য অনেক সামাজিক ও নাগরিক সুবিধার প্রয়োজন হবে।

সে ক্ষেত্রে আলাদা প্রকল্প না নিয়ে সমন্বিতভাবে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেক মন্ত্রণালয়ের দ্বৈততা এড়াতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে পাহাড় ঠাকুরতলা, গোরকঘাটা, উত্তর নলবিলা, ধলঘাটা, হামিদরদিয়া, কুতুবজোম ও ঘটিভাঙ্গা মৌজায় প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, মহেশখালীতে জেগে ওঠা চরে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে। সেখানে একদিকে যেমন বড় বড় বিদ্যুেকন্দ্র হবে, অন্যদিকে গভীর সমুদ্রবন্দর, অর্থনৈতিক অঞ্চল, ইকো পার্ক, ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র, স্কুল, সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ করা হবে। সেখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। মহেশখালীকে শিল্প অঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা (জাইকা) একটি সমীক্ষা করছে বলে জানান পবন চৌধুরী। এক প্রশ্নের জবাবে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, জমির বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে চাহিদা থাকাটাই স্বাভাবিক। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে সবারই জমির প্রয়োজন হবে। সে জন্য মহেশখালীর জমির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি কাজও করছে। এ মাসের শেষের দিকে মহেশখালীতে প্রকল্প এলাকায় পরিদর্শনে যাওয়া হবে বলে জানান তিনি।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.