Leadস্পটলাইট

নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে প্রজ্ঞাপন না হওয়ার ‘অজানা রহস্য’

211157_212180688797935_1649098_nএ.এইচ.রানা ,ঢাকা জার্নাল: ১৯৭৬ সালে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হলেও জাতীয় কবি হিসেবে কোন কোন রাষ্ট্রিয় প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি এই ৩৭ বছরে। রাষ্ট্রিয় বিভিন্ন পুরস্কারে কবিকে পুরস্কিত করা হলেও জাতীয় কবি হিসেবে শুধু মাত্র বই-পুস্তক ও মৌখিক স্বীকৃতিই রয়েছে।

নজরুল ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি হিসেবে মন্ত্রী পরিষদের একটি বৈঠকে প্রস্তাবটি অনুমোদন করা হয়। কিন্তু তা কত সালে তাও ঠিক-ঠাক বলতে পারছেন না ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তাগণ। তবে নতুন করে সরকারের কাছে বিষয়টি আবারো প্রস্তাব করা হবে বলেও জানা গেছে।

নজরুল গবেষকরা মনে করছেন কোন এক অজানা রহস্যের কারণে কোন সরকারই প্রজ্ঞাপনটি জারি করেনি। এদিকে জাতীয় কবি হিসেবে রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতির ব্যাপারে দীর্ঘ দিনেও মাথা ব্যথা নেই কারো। অনেকেই জানেন না যে এখনও পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে কোন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রজ্ঞাপনই প্রধান কথা নয়। কবিকে যে দেশ জাতি গভীর ভাবে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে এটাই যথেষ্ঠ।

এ ব্যাপারে নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক রশীদ হায়দার ঢাকা জার্নালকে বলেন, “একজন মানুষকে সম্মানিত করাতে সরকারি গেজেট প্রকাশ জরুরী নয়। দেখতে হবে কবি নজরুলকে দেশ, জাতি কতটুকু ভালোবাসে। তাছাড়া কবি নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে না মানার একজনকেও পাওয়া যাবে না। তাই প্রজ্ঞাপন কেন জারি হলো না এটা এখন কোন আলোচনার বিষয় হতে পারে না।”

এ প্রসঙ্গে নজরুল ইনস্টিটিউটের সচিব ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলে, “ঠিক বলতে পারছি না কোন সরকারের আমলে নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে একটি প্রস্তাব কেবিনেটে অনুমোদন করা হয়েছিল। সম্ভবত এরশাদ সাহেবের আমলেই প্রস্তাবটি অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি এব্যাপারে।”

তিনি বলেন, “তবে আমরা আবারো মন্ত্রণালয়ে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। আমরা  সাংস্কৃতিক মন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে নতুন করে এ বিষয়ে কথা বলেছি। আশা করছি খুব শীঘ্রই কিছু একটা করা যাবে।”

দীর্ঘ দিনে রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারি না করার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সচিব বলেন, “আসলে প্রজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তা ছিল না। প্রজ্ঞাপন জারি না হলেও তো আমরা নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছি এবং সবাই তা মেনেও নিয়েছেন। কারো কোন মত পার্থক্য দেখি না ”

প্রজ্ঞাপন জারি না হলে কবিকে নিয়ে অবমাননাকর কিছু ঘটলে তা আইনী প্রক্রিয়ার অধীনে এনে সমাধান করা যাবে কিনা এমন প্রশ্নে উত্তরে তিনি বলেন, “এটা সত্য কথা যে যদি কখনো কবিকে নিয়ে কোন প্রকার অবমাননাকর কিছু ঘটে তাহলে প্রজ্ঞাপন থাকলে বিষয়টি বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধান করা যাবে। কিন্তু আসলে কবিকে সবাই ভালোবাসেন,কেউই কবির অবমাননা মেনে নিবে না বা কবিকে অমাননা করে কিছু করবে না এটা সবার বিশ্বাস। তবুও বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন।”

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নজরুল ইনস্টিটিউটের একজন কর্মকর্তা বলেন, “নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে ইনস্টিটিউটের কিছুই করার নেই। কারণ এবিষয়টিতে উদাসিন মুলত সরকার।”

তিনি বলেন, সরকারি উদ্যোগ ছাড়া এটা সম্ভব নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুনিজন ও নজরুল গবেষক বিষয়টি সরকারের কাছে জানালেও সরকার বিষয়টি কর্ণপাত করনি।

 

নজরুল গবেষনার অধিকাংশ হচ্ছে কবি ভবনে

কবি কাজী নজরুলের সাহিত্য কর্মে উপর অধিকাংশ কাজই করছে কবি ভবন। এখনও পর্যন্ত নজরুলের বিভিন্ন রচনা ও সাহিত্য কর্ম সংগ্রহ, সংরক্ষন ও প্রচারের কাজগুলো নজরুল ইনস্টিটিউটই করে আসছে। সরকারি ভাবে অন্য দুটি সংস্থা বাংলা একাডেমী ও জাতীয় শিল্পকলা একাডেমীর এধরণের কাজ করার কথা থাকলেও তা হচ্ছে যতসামান্য।স্বপ্ল জনবল নিয়ে নজরুল গবেষনা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে কবি ভবন।

এব্যাপারে ইনস্টিটিউটের ডেপুটি পরিচালক রেজা উদ্দিন স্টালিন বলেন, “খুবই অল্প সংখ্যক লোক বল নিয়ে নজরুল ইনস্টিটিউট কাজ করে আসছে। এখানে একজন পরিচালক পর্যায়েরও কোন কর্মকর্তা নেই। মাত্র ৫-৬ জন কর্মকর্তাদের নিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে আমাদের। এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি বা পেনশনের কোন ব্যবস্থা নেই।”

তিনি বলেন, “সামান্য লোক বল নিয়েই আমরা বিভাগীয় শহরগুলোতে নজরুল সম্মেলন করে আসছি। এখন শুধু মাত্র বরিশাল বিভাগের সম্মেলন বাকি রয়েছে।”

রেজা উদ্দিন স্টালিন বলেন, আমরা এই পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন’শ বই প্রকাশ করেছি। সিডি বের করেছি ৪২টি। প্রায় এক হাজার আট’শ গান গ্রামোফোন রেকর্ড হতে রেকর্ড করেছি। এখন পর্যন্ত আমরা প্রায় চার হাজার নজরুলের বিভিন্ন বাণী সংগ্রহ ও সংরক্ষন করেছি। নজরুল ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত একহাজার শিল্পীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। যারা নিজেরাও প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করতে পারবে।

তিনি বলেন, নজরুল ইনস্টিটিউট নজরুলকে নিয়ে যত কাজ করছে তার অর্ধেকও করছে না বাংলা একাডেমী বা শিল্পকলা একাডেমী। শুধু মাত্র নজরুলের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার জায়গা থেকে স্বল্প সুযোগ সুবিধা নিয়েও এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে।

নজরুলের উপর গবেষনা ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নজরুল ইনস্টিটিউটের সচিব ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, নজরুলের বিভিন্ন গানের স্বরলিপি আমরা প্রকাশের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এই প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে ২৩ লাখ টাকার একটি বাজেট সরকারকে দেয়া হয়েছে। মোট ৩৬ খণ্ডের বইয়ের মাধ্যমে এই স্বরলিপি প্রকাশ করা হবে।

তিনি বলেন, এপর্যন্ত আমরা নজরুলের প্রায় তিন হাজার ছয়’শ গান সংগ্রহ করেছি। যার মধ্যে প্রায় এক হাজার চার’শ গান সংগ্রহ করেছি আদি গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে। এসব গান শুনে সেগুলোর গায়কী স্বরলিপি করা হচ্ছে, যাতে নজরুলের গানের সুরের কোন বিকৃতি না ঘটে। নজরুল সংগীত শিল্পী ও গবেষক শচীন দাসের সভাপতিত্বে একটি কমিটি সে কাজগুলো করছে। ইতো মধ্যে কমিটি প্রায় আট’শ গানের প্রকৃত স্বরলিপি লিখিত আকারে শেষ করেছে।

সম্প্রতি নজরুলের সাহিত্য কর্ম ও বিভিন্ন রচনা ডিজিটাল আকারে ওয়েব সাইটে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান সচিব ফরিদ আহমেদ।

তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে এব্যাপারে একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়েছি। তাছাড়া বিষয়টি নিয়ে আমরা বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সঙ্গেও কথা বলেছি। খুব শীর্ঘই আমরা নজরুলের বিভিন্ন গানের স্বরলিপি, কবিতা ও রচনা ইনস্টিটিউটের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করা হবে।

তিনি বলেন, নজরুলের বিভিন্ন বই আমরা ই-বুক ফরমেটে করেও তা ওয়েব সাইটে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

নজরুল গবেষনার প্রসারে জন্য ত্রিশালে স্থাপিত নজরুল ইনস্টিটিউটের জন্য সম্প্রতি লোকবল নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। ১৩টি পদের বিপরীতে সরকারি ভাবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়েছে।

নজরুলের সাহিত্যকর্ম বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক রশিদ হায়দার। তিনি বলেন,ইতোমধ্যেই আমেরিকা, ইংল্যান্ডে নজরুলের উপর বিভিন্ন গবেষনা হয়েছে। তাছাড়া নজরুলের কবিতা ও রচনা সমগ্র ইংরেজি, হিন্দী, উর্দু, ফারসি, চীনা, স্প্যানিসসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হচ্ছে। নজরুল ইনস্টিটিউট সরাসরি এই কাজগুলো না করলেও তাদের দিক নির্দেশনায় বিভিন্ন দূতাবাস এই কাজগুলো করছে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.