‘তারা কোন ধর্ম পালন করে?’
ঢাকা জার্নাল : পহেলা বৈশাখ উদযাপনের বিরোধিতাকারীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিরোধীকারিরা আদৌ কোনো ধর্ম পালন করেন কি না- তা নিয়েও তিনি সংশয় প্রকাশ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশে তো বহু পার্বণ আছে। আমরা ঈদ করি, সাথে সাথে আমাদের পহেলা বৈশাখ- এটাও আমরা উদযাপন করি। এখানে ধর্মীয় কোনো বাধা দেওয়ার কিছু নেই। যারা নিষেধ করে, তারা কেন করে তা করে আমি জানি না। তারা কোন ধর্ম পালন করে সেটা নিয়েও সন্দেহ ‘
পাশাপাশি ধর্মের প্রতি আঘাতকারীদের সতর্ক করে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন,সহনশীলতার সঙ্গে সংস্কৃতি ও ধর্ম পালন করুন।
১৪২৩ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) গণভবনে দলীয় নেতাকর্মীরা প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতে গেলে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।পহেলা বৈশাখ উদযাপনের বিরোধীতাকারীদের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটাকে অনেকেই অনেক রকম মন্তব্য করার চেষ্টা করে। কেউ বলে ফেলে যে এটা হিন্দুয়ানি। আমরা মুসলমান হলেও বাংলাদেশের বাস করি। আমরা তো বাঙালি। কারণ বাঙালি হিসেবে যুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা বাঙালি হলে যে মুসলমান হতে পারবো না এ রকম তো কোনো কথা নেই। ধর্মে কোথায় লেখা আছে?’
শেখ হাসিনা বলেন, “আজকে পৃথিবীতে যেসব দেশে মুসলমান আছে সেই সব দেশের নামেই তো সেই জাতির নাম। আরব দেশের যারা তাদের অ্যারাবিয়ান বলেই তো সবাই ডাকে। প্যালেস্টাইনের যারা প্যালেস্টাইনি বলেই ডাকা হয়। প্রত্যেকেরই তো পরিচয় একটা একটা দেশ, ভৌগলিক সীমারেখায় সেই পরিচয় দেওয়া হয়।
‘তবে কি তাদের মুসলমানিত্ব চলে যাচ্ছে?’-এ প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের মুসলমানিত্বতো চলে যাচ্ছে না।”বাংলাদেশে জাতিগত সাংস্কৃতিক উৎসব পালনের বিরোধিতাকে দুর্ভাগ্যজনক মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমাদের খুব দুর্ভাগ্য যে, আমাদের একেক দল একেক রকম করে কথা বলতে শুর করে। আমাদের এই দেশে যুগ যুগ ধরে আমাদের যে সংস্কৃতি, আমাদের যে রীতি-নীতি, সেগুলো আমরা পালন করি। যার যার ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী ধর্ম পালন করে। একটা সহনশীলতা নিয়ে আমরা বসবাস করব, যেন আমাদের দেশে শান্তি বজায় থাকে। সবচেয়ে বড় কথা শান্তি। কারণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ছাড়া কখনো উন্নতি হয় না।
তিনি বলেন, দেশে শান্তি আছে বলেই প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে এবং এই পহেলা বৈশাখ একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত নববর্ষ উদযাপিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে এবারই প্রথম সরকারি চাকুরেদের জন্য বৈশাখী উৎসব ভাতা চালু হয়েছে। অন্যদিকে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে উন্মুক্ত স্থানে বিকাল ৫টার মধ্যে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান শেষ করতে বলা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে কড়াকড়ির জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানিয়ে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধের দাবি জানিয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থক ওলামা লীগ। আর বৈশাখী উৎসব ভাতা বাদ দিয়ে ঈদ-ই মিলাদুন্নবিতে উৎসব ভাতা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে তারা।
ইসলাম ধর্মে সহনশীলতার শিক্ষার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের ধর্ম আমরা সবাই পালন করি। আর ইসলাম ধর্মেই নির্দেশনা আছে যে, যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। এখানে কারও ধর্মের ওপর আঘাত দেওয়ার কথাতো বলা হয়নি। নবী করিম (স.) তো বলেই গেছেন যে, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। আর এই যে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে নানা ধরনের কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করা, থ্রেট করা, বোমা মেরে মানুষ হত্যা করা বা মানুষের জীবনের ওপর হুমকি দেওয়া- এটা ধর্মের কোথায় বলা আছে? যারা এ ধরনের হুমকি দেয় তারাই তো আমাদের ধর্মকে অবমাননা করে, ধর্মের বদনাম করে।
বিকাল ৫টার মধ্যে উন্মুক্ত স্থানে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশনার সমালেচনা যারা করছেন, তাদেরও জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আরেকটা গ্রুপ আছে। আমরা মানুষের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সব সময় সচেতন। একটা নিরাপত্তা বলয় তৈরি করার জন্য কী কী করণীয় আমরা তার কতকগুলো অনুশাসন দেই। এ নির্দেশনা দেওয়াতে অনেকে দেখলাম ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। যিনি ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, তাকে আমি বলতে চাই, যদি কোনো অঘটন ঘটে, তার দায় কী তিনি নেবেন? তাকেই নিতে হবে। এটা মাথায় রাখতে হবে।’ ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদীদের হামলার ঘটনা তুলে ধরে তিনি নির্দেশনা মেনে শান্তিপূর্ণভাবে উৎসব উদযাপন করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান।
ধর্মীয় প্রসঙ্গ নিয়ে লেখালেখির ক্ষেত্রে সতর্ক করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আরেকটি বিষয় বলব, কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে লেখা কখনো গ্রহণযোগ্য না। এখন একটা ফ্যাশন দাঁড়িয়ে গেছে যে, ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু লিখলেই তা হয়ে গেল মুক্তচিন্তা। আমি এটাকে মুক্তচিন্তা দেখি না। আমি এটাকে দেখি নোংরামি। এত নোংরা নোংরা লেখা কেন লিখবে?’
“আমি আমার ধর্ম মানি, আমি যাকে নবী মানি তার সম্পর্কে নোংরা কথা যদি কেউ লেখে, সেটা কখনো আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না। ঠিক তেমনি অন্য ধর্মেরও যারা, তার সম্পর্কেও কেউ কিছু যদি লেখে, তাহলে এটা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। ধর্ম বা অন্য ধর্মের অবমাননা করে লেখালেখিকে ‘নোংরা ও বিকৃত মনের পরিচায়ক’ আখ্যায়িত করেন শেখ হাসিনা।
‘একজন মুসলমান হিসেবে আমি প্রতিনিয়ত ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলি। সেটা নিয়ে যদি কেউ লেখে, তাহলে আমার নিজের কষ্ট হয়। আর এই লেখার জন্য কোনো অঘটন ঘটলে সেটা সরকারের ওপর আসবে কেন?’ সবাইকে ‘সংযম ও শালীনতা’ বজায় রেখে ‘অসভ্যতা’ পরিহার করার আহ্বান জানান তিনি।
ধর্মের নামে যারা মানুষ খুন করে, তাদের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মানুষ খুন করার মধ্যে সমস্যার সমাধান নাই। একজন লিখল, আর একজন খুন করে প্রতিশোধ নেবে এটাও তো ইসলাম ধর্ম বলেনি। বিচার তো আল্লাহ করবে। আল্লাহই তো বলে দিয়েছেন, উনিই শেষ বিচার করবেন। যাদের আল্লাহর ওপর ভরসা নেই তারাই এই খুন-খারাবি করতে চায়। কারণ তারা আসলে আল্লাহ রসুলও মানে না, তারা নিজেরাই আল্লাহর কাজ করতে চেষ্টা করে। এটা তো শিরক।”
সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন বছরে বাংলাদেশের আরও অগ্রগতি প্রত্যাশা করেন প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সমাগতদের মিষ্টি, ফলসহ বিভিন্ন খাবারে আপ্যায়িত করা হয়।
ঢাকা জার্নাল, এপ্রিল ১৪, ২০১৬।