মত-অমত

টেলিভিশন নাটকে নারী : সালমা আহ্‌মেদ

equal-pay

সালমা আহ্‌মেদ  : আমি টেলিভিশন মিডিয়ার একজন দর্শক। দর্শক সারির প্রতিনিধি হয়েই আজ লিখতে বসলাম। আমার কলামের শিরোনাম দেখে পাঠক নিশ্চয় অনুধাবন করতে পারছেন আমার বিষয়বস্তু ‘নারী ও টেলিভিশন’। রাষ্ট্র ও সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সংস্কৃতিতে নারীর অবস্থানটি এসে যায়। কারণ সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র সমাজেরই অংশ। অন্যদিকে সংস্কৃতি’র একটি বড় অংশ মিডিয়া। সেই মিডিয়া অর্ন্তভুক্ত করে টেলিভিশনকে। আবার টেলিভিশনে নারীর অবস্থান নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অনিবার্যভাবেই যে বিষয়টি এসে পড়ে তা হলো ‘জেন্ডার ইস্যু’। তাবৎ দুনিয়া জুড়ে গবেষক সমালোচকদের কাছে এই ইস্যুটি ইদানীং বেশি প্রধান্য পাচ্ছে সন্দেহ নেই, পুরোপুরি যৌক্তিক কারণেই বিষয়টি তাদের কাছে প্রাধান্য পেয়ে আসছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সৃষ্টির শুরুতে মানব সমাজ মাতৃতান্ত্রিক থাকলেও আবিষ্কারের পর এক সময় তা পুরুষের দখলে চলে যায়, যা আজও অব্যাহত আছে। কিন্তু, এখন মানুষের চিন্তা চেতনার পরিবর্তনের যুগে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত অসংবেদনশীল সমাজ এখন আগের চেয়ে কিছুটা হলেও সংবেদনশীল বলা যায়, বিশ্ব জুড়ে এই সংবেদনশীল জনগোষ্ঠীই এখন নারীর অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। আর এই সংবেদনশীল জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য হিসেবে আমার আজকের এই লেখার সূত্রপাত।

টেলিভিশন মিডিয়ার বিভিন্ন ক্ষণে নারীদের অবস্থান
পাঠক আপনারা জানেন, সমাজের প্রতিটি স্তরের মতো এখানেও নারী অবহেলিত। এই অবহেলার ধরন আলাদা। অবহেলা ও বৈষম্যের এই রকমফের দেখাতে আমি নাটকে নারীর অবস্থা নিয়ে অল্পবিস্তর লেখার চেষ্টা করছি। আমার এই লেখায় তিনটি দিকের ওপর আমি জোর দেবো:

১. টেলিভিশন নাটকে নারী – সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ
২. টেলিভিশন নাটকে নারী – ভিন্নমত
৩. প্রস্তাবিত সুপারিশমালা

টেলিভিশন নাটকে নারী – সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ
বাংলাদেশে একটি সরকারী চ্যানেল এবং ২৪টি বেসরকারী স্যাটেলাইট চ্যানেলসহ বর্তমানে মোট ২৫টি টেলিভিশন চ্যানেল চলছে। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় টেলিভিশনে নারীদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত নগণ্য। প্রশাসনিক পর্যায় থেকে কারিগরী পর্যায় হয়ে অভিনয়কলায় এসেও আমরা দেখি, নারীরা অবহেলিত। আশপাশ থেকে শুনতে পাই নারীরা প্রশাসনিক কাজে দক্ষ নয়। প্রবীনরা কারিগরী ক্ষেত্রে আগ্রহী নতুন মেয়েদেরকে বলেন এ কাজের জন্য যে সক্ষমতার প্রয়োজন তা মেয়েদের নেই। আর মেয়েদের অভিনয়ের ক্ষেত্রে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন এখনো ঘটেনি। যেটুকু ঘটেছে তা খুবই সামান্য। এই সামান্য পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতেই এখন টিভি মাধ্যমের প্রশাসনিক এবং কারিগরী ক্ষেত্রে সামান্য সংখ্যক নারীকে দেখা যায়, আর অভিনয়ে মেয়েদের আগের চেয়ে কিছুটা বেশি দেখা যায়। কিন্তু, আমি আবারও বলব, এখনো টিভি মাধ্যমে কর্মরত নারীদের প্রতি আমাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গীর মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেনি। আমার ইচ্ছে সামগ্রিক বাংলা সংস্কৃতির আলোকে বাংলাদেশের টিভি নাটকে বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্য সম্পর্কে কথা বলা। আমাদের বঙ্গদেশ, যার অংশ বিশেষ এখন বাংলাদেশ । আমরা যদি এখানকার সৃজনশীল কর্মকান্ডের দিকে তাকাই, তবে দেখতে পাবো একটি পুরুষ শাসিত সমাজের অবয়ব। এই অবয়ব আমাদের পূর্বপ্রজন্ম অতীতে দেখেছেন, এখন আমরাও দেখতে পাচ্ছি। আমরা যদি বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা ধরি, তাঁর উপন্যাসেও আমরা দেখি চরিত্রের বিচারে মেয়েরা সেকেন্ডারি এলিমেন্ট। পুরুষরাই একমাত্র প্রাইমারি এলিমেন্ট। যেখানে নারীকে তুলে ধরা হয়েছে সুন্দরী ও সেবিকা হিসাবে। বলাবাহুল্য এর সবই পুরুষের জন্য, কিন্তু শরৎসাহিত্য যে বিস্তর লিঙ্গ বৈষম্যে জর্জরিত তা আমরা কেউ উপলব্ধি করতে পারিনা। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা কেউ তা উপলব্ধি করতে চাইওনা। আমরা কিন্তু শরৎসাহিত্য কিংবা সামন্ত যুগের অবস্থা থেকে খুব একটা বেরিয়ে আসতে পারিনি। শুরুতেই আমি বলব বাংলাদেশ টেলিভিশন সংস্কৃতির শুরুর দিন থেকে আজ পর্যন্ত ক’টা নাটক আমরা দেখেছি, যার নাম ভূমিকা বা মূল ভূমিকাটা একজন নারীর? আমি তো ‘করি মন বেওয়া’ বা অন্য দু একটি নাটক ছাড়া খুব বেশি সংখ্যক নাটক খুঁজে পাচ্ছি না। এই অবস্থা কখনোই বদলাবে না, যতক্ষণ না আমাদের মধ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টি হয়। আমি হয়তো আমার আলোচ্য বিষয় থেকে একটু দূরে সরে যাচ্ছি। সত্যি কথা বলতে কি, সরে যেতেই হবে। এছাড়া কোনো উপায় নেই । কারণ টেলিভিশন আমাদের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো মাধ্যম নয়। টেলিভিশন হলো সমাজের প্রতিবিম্ব। অনেকেই হয়তো এটা লক্ষ্য করেন না। আমরা যদি বাংলাদেশের উৎপাদন কর্মকাণ্ডের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে সেখানে ৬০% এরও বেশি ভূমিকা রাখছে নারী । জমিতে লাঙ্গল দেয়া থেকে শুরু করে মই দেয়া, ধান মাড়াই, ধান সেদ্ধ করা, ধান শুকানো সব কাজই করে নারী। একই সাথে তারা কিন্তু গৃহকর্ম থেকেও বিচ্যুত নয়। তিন বেলা রান্না করতে হচ্ছে, স্বামী সন্তানকে সময় মতো খাবার দিতে হচ্ছে। এমনকি বাচ্চার টিকা দেওয়ার তারিখটাও মাকে অর্থাৎ নারীকে মনে রাখতে হচ্ছে। এই যে ঘটনা, এটার প্রতিচ্ছবি কিন্তু আমরা বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখতে পাই না। হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন বা অন্য যারা আমাদের এখানে টিভি নাটক লেখেন, তাঁদের নাটকেও মেয়েদের ভূমিকা সীমাবদ্ধ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে তাঁরা এ-ক-টু হয়তো বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। এইটুকু অগ্রগতি বাদ দিলে তারা শরৎচন্দ্রতেই রয়ে গেছেন। প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত আলী যাকের অভিনীত একটা নাটকের কথা বলি, নাটকটির নাম ‘বহুব্রীহি’। সেখানে মামা (আলী যাকের) এবং দুলাভাই (আবুল হায়াত) এবং তাদের ছেলে ভৃত্য – এই তিনজন পুরুষ ছিল মূল চরিত্রে। বাকী সব নারীরা সহশিল্পী। এসব সহশিল্পীর নাম কিন্তু কেউ কখনো মনে রাখে না। এবার আমি হুমায়ূন আহমেদের ‘অয়োময়’ এর দিকে একটু তাকাবো। খুবই হৃদয়স্পর্শী একটি নাটক। কিন্তু দর্শকের যাবতীয় সহানুভূতি আদায় করে নিয়েছেন নবাব। যে চরিত্রটিতে আসাদুজ্জামান নূর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন। যদিও নাটকটিতে চারটি নারী চরিত্র ছিলো, এলাচী, দারুচিনি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সবগুলো চরিত্র ছিলো সেকেন্ডারি।

২০০৩ সালে আবুল হায়াত পরিচালিত ‘ধিক লক্ষবার’ নাটকের মূল চরিত্রও একজন পুরুষ। এক্ষেত্রে সেই চরিত্রের স্ত্রীরূপে যাকে দেখানো হয়েছিলো, সেটা কিন্তু মূল চরিত্র হতে পারত। সে সুযোগ পরিচালকের ছিলো। কিন্তু সুযোগের বাস্তবিক ব্যবহার করা হয়নি। কেন? এই উত্তর আমাদের সবার জানা। তারপরও একটি প্রশ্ন আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তা হলো- নাটকে মেয়েদেরকে তার সনাতন চিন্তা-চেতনার গন্ডি পার হয়ে নিজ শক্তি, মেধা ও মননে প্রত্যয়ী হয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টাকে তেমন প্রতিফলিত করা হয়নি। পুঁজিবাদ ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় (এক্ষেত্রে অনেক মহিলা নাট্যকার) নারীকে একই ভূমিকায় বারবার তুলে এনেছেন। যেমন, কম বয়সী হলে গ্রামের পটভূমিতে কোনো চঞ্চলা তরুণী অথবা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে প্রেমিকের তুষ্ট করা কথায় আপ্লুত কিংবা কোনো মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত ঘরের নারীর মুখে দু’চারটি আদর্শ ও তার পরিবারের প্রতি দায়িত্বের কথা তুলে দিয়ে নাট্যকার যেন দায় সারেন। মা চরিত্রে যিনি থাকেন তার মুখে প্রতিনিয়তই থাকে একই গৎবাধা বুলি। যাবতীয় দায়-দায়িত্ব হলো সংসার আগলে রাখা। এ প্রসঙ্গে এনটিভিতে প্রচারিত ‘স্পর্শের বাইরে’ নাটকটিতে মা চরিত্রে আফরোজা বানু’র কথাটি উদাহরণ হিসাবে না বললেই নয়। সেখানে তিনি প্রতিটি মুহূর্তে সংসারকে টিকিয়ে রাখার জন্য সময় ব্যয় করছেন। কিন্তু বারবারই ব্যর্থ হচ্ছেন। মা-জাতি কি এতটাই দূর্বল? ধৈর্য ধরো, সম্মান ক্ষুণ্ন কোরোনা, চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বামীর সংসার করো ইত্যাদি সংলাপ ব্যবহার করে নারীকে বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া থেকে বিরত রাখা হয়েছে। তার অহংকার এবং মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। নারী সমাজের নিজ যোগ্যতা, ক্ষমতা এবং স্বাধীন মতামত প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে প্রকারান্তরে করা হচ্ছে বিঘ্নিত। এই সমাজে নারী শিশুকাল থেকেই হয় পিতা, না হয় ভাই, স্বামী বা পুত্রের মুখাপেক্ষী। নারী সমাজের এই অসহায় অবস্থাটিকেই প্রচ্ছন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে তুলে ধরা হচ্ছে গণমাধ্যমের বিশেষ হাতিয়ার হিসেবে আমাদের ‘টিভি নাটকে’। এমন কোনো ‘মা’ চরিত্র আমরা দেখতে পায়না, যেখানে মা তার মেয়েকে জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কিংবা নিজ বিশ্বাসে অটল থেকে পরিস্থিতির মোকাবেলা করার পরামর্শ দিচ্ছেন। বরং আমরা মা-মেয়ের সংঘাতকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখি আমাদের নাটকের চরিত্রে। এনটিভিতে প্রচারিত ‘স্পর্শের বাইরে’ নাটকটিতে মেয়ের ছেলে বন্ধু আছে বলে মায়ের অপছন্দকে সংঘাতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। অন্যদিকে বাবাকে শান্ত ও সহনশীল রূপেই তুলে ধরা হয়েছে। তাহলে কি এটাই প্রমাণিত হয়না নারীই নারীর শত্রু এবং নারী অসহনশীল? গণমাধ্যম এ ধরনের বার্তা প্রচার করে আমাদের কাছ থেকে বাহবা পেতে চান। আমাদের নাটকের নারী চরিত্রের বৈশিষ্ট্য কম্প্রোমাইজিং বা আপোষকামী। সন্দেহ নেই যে এই প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত আছে। চরিত্রগুলো এইরকম- ‘নারী চাকরি করতে চায়। স্ত্রী চাকরি করুক স্বামী তা পছন্দ করেন না। এ নিয়ে মনোমালিন্য এবং সাময়িক বিচ্ছেদ। এরপর দেখা যাবে সংসার ত্যাগ করার কারণে ব্যক্তিগত জীবনে নারীটি অসুখী, অনুতপ্ত। রাতে তার ভালো ঘুম হয়না। গল্পের এ পর্যায়ে আমাদের নাট্যকাররা এটাও প্রতিষ্ঠিত করে দেন যে, দু’টি চরিত্রের সম্পর্কের টানা-পোড়েনকে কেন্দ্র করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে অশান্তি বিরাজ করছে তার জন্য একমাত্র দায়ী অবাধ্য স্ত্রীটি। চূড়ান্ত পর্যায়ে নাটকটিতে আমরা দেখি, অতঃপর স্ত্রী তার ভুল বুঝতে পারে। সে চাকরি ছেড়ে দেয় এবং নিজের ভুল স্বীকার করে স্বামীর কাছে ফিরে আসে। তাদের সংসারে আবার শন্তি ফিরে আসে। এভাবেই নারীর পরাজয়কে ভালোত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। আমার প্রশ্ন হলো ‘আমাদের সমাজচিত্র কি এতটাই পশ্চাদপদ? গত এক দশকে নারীদের শিক্ষার হার কি পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম? নারীরা কি চাকরি করছে না? নারীরা কি কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে? সব স্বামী কি তাদের স্ত্রীদের চাকরি করা থেকে বিরত থাকতে বলেন? তেমনটি করা কি কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত বা সঠিক? কিন্তু তাই বলে নাটকে যখন দেখানো হয়, আমাদের সমাজে নারীরা কাজ করলে বা করতে চাইলে সংসারে তার ফল খুবই খারাপ হয়, তখন তা প্রকারান্তরে নারীর কাজকে স্বীকৃতি না দিতেই উৎসাহিত করে এবং কর্মজীবী নারীকে নিরুৎসাহিত করে। মিডিয়াকে ব্যবহার করে এমন একটা ‘নেতিবাচক’ বার্তাকে প্রতিষ্ঠা করার বিষয়কে আমি অন্তত নৈতিক মানদণ্ডে ভালো কোনো কাজ বলবো না। কেননা, আজকাল মেয়েরা চাকরি করছে। কর্মক্ষেত্রে তারা সাফল্য পাচ্ছে। অনেক নারী পারিবারিক বাধা পেরিয়ে চাকরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় এ ধরনের নাটক প্রত্যক্ষ করার পর আত্ননির্ভরশীল হবার চেষ্টা করছে যে মেয়েটি, সে কিন্তু মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে। সে ভাববে এটাই তাহলে সত্যি। আমাকে তাহলে এভাবে ঘরের ভেতর কাজ করে সংসার টিকিয়ে রাখতে হবে। নতুবা সংসার ত্যাগ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের প্রচার মন্ত্রী ‘জোসেফ গোয়েবলস’ এর কথাটি না বললেই নয়। তিনি বলেছেন – ‘একটি মিথ্যা দশবার বললে তা সত্যে পরিণত হবে’। তেমনি নাটকেও যদি বার বার নারী চরিত্রকে এভাবেই বিকৃত করে দেখানো হয়, তবে একদিন এই বিকৃত চিত্রই সত্য বলে মনে হবে। নাটক আর লেখনী হলো সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। আমি নাটক বানালাম, অথচ তাতে সমাজ পরিবর্তনের বার্তা থাকলো না, সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরলাম না, নিছক সস্তা বিনোদনই দিলাম – এ ধরনের নাটকের নির্মাতাকে নিশ্চয় আপনারা একজন সফল নাট্যনির্মাতা বলবেন না। কেউ যদি লিফলেট, পোস্টার দিয়ে সারা দেশ ছেয়ে ফেলে, সেটা মানুষ যতটা আগ্রহ নিয়ে দেখবে তার চেয়ে বেশি আগ্রহ নিয়ে দেখবে নাটক কিংবা জারির গানের আসর। কারণ তা সব শ্রেণীর দর্শকদের স্পর্শ করে। একজন নাট্যকারের সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি অঙ্গীকার থাকা উচিত। টিভিতে দ্বি-ভুজ, ত্রি-ভুজ, চতুর্ভুজ জাতীয় প্রেমকাহিনী দেখতে দর্শক এখন ত্যক্ত বিরক্ত। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের উচিত শিশু ও নারী অধিকার, কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায়, শিক্ষা-উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়কে উপজীব্য করে নাটক তৈরি করা। নারীরা শুধু কলহপ্রিয় এই বিষয়গুলো নাটক থেকে বাদ দিতে হবে। চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত জনপ্রিয় নাটক ‘একান্নবর্তী’ নাটকে আমরা নারীদের উন্নয়নমূলক কোনো ভূমিকায় দেখিনি। বরং দেখেছি, নারীরা সর্বদা কলহপ্রিয়। ঝগড়া করে সময় কাটানো ছাড়া তাদের কোনো কাজ নেই, অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং সংসার ভেঙে দেবার প্রবণতাও তুলে ধরা হয়েছে সেখানে। অথচ এমন একটি নাটকে নারীদের অবস্থানকে আরো মজবুত করে উপস্থাপন করা যেতো। আমাদের অনুধাবন করতে হবে, জনপ্রিয় নাটকগুলো কিন্তু বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। বিটিভিতে প্রচারিত ‘স্বপ্ন সোনার গাঁও’ নাটকে ইশা খাঁ’র চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এবং একজন পুরুষকে সবার সামনে অতিমানব রূপে উপস্থিত করা হয়েছে। অথচ কোন টিভি চ্যানেলেই কর্মজীবী নারী বা মুক্তিযোদ্ধা নারীদের আমরা দেখতে পাই না। মুক্তিযুদ্ধের নাটকগুলোতে নারীকে ধর্ষিতারূপে প্রতিস্থাপন করা হয়। তাদের অবদানকে স্বীকার করা হয় না।

ভিন্নমতঃ
১। আমাদের দেশের টেলিভিশন অন্যান্য দেশের মতো নারীর সহায়ক অনুষ্ঠান বা নাটক সম্প্রচার না করলেও নারীর ব্যক্তিত্ব বিকাশে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি কিছু প্রতিভাবান নারীকে তাঁর প্রতিভা বিকাশের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে- একথা বলা যায় নির্দ্বিধায়। তবে এর সংখ্যা খুবই কম।

২। স্বাধীনতা পূববর্তী সময়ে নাটকে মেয়েরা আসতে পারেনি, তবে এখনতো রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে।

প্রস্তাবিত সুপারিশমালাঃ

১. একজন মেয়ে তখনই অভিনয়কে শুধু শখ হিসেবে নয়, বরং তার জীবিকা এবং ভালোবাসার ফসল হিসেবে নিতে পারবেন, যখন নারী চরিত্রগুলো বলিষ্ঠভাবে, ভিন্নতর অবয়বে নাটকে তুলে ধরতে পারা যাবে। নাট্যকার, উপস্থাপক, বিজ্ঞাপন নির্মাতা, পত্রিকার প্রতিবেদক যদি তাদের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়ে নারীর ও মেধার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটিয়ে নারীর কর্মদক্ষতাকে উপস্থাপন ও কাজে লাগাতে পারেন তাহলেই শিল্পের এই দিকটি সমৃদ্ধ হবার পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবে।

২. রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে মেয়েদের অগ্রণী ভূমিকা, গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর নীরব শ্রম ও অবদানকে স্বীকার করে যদি নারীদের ক্রমবর্ধমান অগ্রযাত্রাকে সুন্দরভাবে গণমাধ্যমে প্রতিফলিত করা যায় এবং লেখক, সাহিত্যিক, নাট্যকার, প্রযোজক, পরিচালকরা যদি সকল ক্ষুদ্র চিন্তা বা ক্ষুদ্র স্বার্থের উর্দ্ধে থেকে নারীকে তার স্ব-মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে এগিয়ে আসতে সাহায্য করেন, তবেই আমরা নারী প্রগতি, নারী মুক্তি, নারীর ক্ষমতায়নের কথা ভাবতে পারবো। সন্দেহ নেই এ ব্যাপারে সবচেয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে আমাদের জাতীয় প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন। পাশাপাশি অন্যান্য বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে।

৩. নারীকে শুধু পণ্য, লভ্যবস্তু, বিশেষ বিশেষ শব্দ বা বিশেষণে ভূষিত করা এবং লুফে নেয়া কোনো বিশেষ সামগ্রী হিসেবে যেন উপস্থাপন না করা হয়। নারী ও পুরুষকে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রাখতে হবে এবং সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে।

৪. সমাজে নারীর প্রকৃত অবস্থা ও অবস্থান টিভি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে হবে। নাটকের চরিত্রায়ন হতে হবে বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বঞ্চিত ও নির্যাতিত নারীকে টিভি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি তার অধিকার ও অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো বেশি সক্রিয় হতে হবে।

৫. শুধু সভানেত্রী হিসেবে নয়, প্রশাসনে, ব্যবস্থাপনা, কলাকুশলী, নাট্যকার, প্রযোজক, পরিচালক হিসেবে টেলিভিশনে মেয়েদের অবস্থান শক্তিশালী করতে হবে।

৬. দক্ষতা বৃদ্ধিতে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা খুবই জরুরী।

৭. টেলিভিশনে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে সরকারের নীতির পরিবর্তন প্রয়োজন। জরুরী বিটিভি’র স্বায়ত্ত্বশাসনও।

৮. টেলিভিশনে নারীকে কিভাবে, কতভাবে খাটো করা হচ্ছে সে বিষয়ে গবেষণাকর্ম বাড়াতে হবে। তাহলে হয়তো সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ সহজতর হবে। এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের নজরদারি আরো বাড়াতে হবে।

৯.বেসরকারি সংস্থাগুলোর উচিত নারী বিষয়ক, বিশেষ করে গণমাধ্যমে নারী বিষয়ক আরো কর্মশালা এবং বিদ্যমান সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আরো কিছু কার্যকর উদ্যোগ নেয়া।

১০. নারী কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে। রাতের শিফটে কাজ করার ক্ষেত্রে পরিবহন সুবিধা দেয়া প্রয়োজন।

১১. যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে নারীর সমান অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সঠিকভাবে মূল্যায়িত হতে হবে নারী শিল্পীদের কাজ এবং তাদের অবস্থান।

১২. নাট্যকারদের উচিত এমনভাবে নাটক নির্মাণ করা যাতে নারীর সমস্যা এবং তার সামাজিক প্রভাব ফুটে উঠে। নাটকের যেহেতু একটি সামাজিক আবেদন আছে তাই রোমান্টিক ও বিনোদন নির্ভর নাটকের পাশাপাশি নারীর প্রতি অবহেলা নির্যাতনকে তুলে ধরা উচিত। এর সাথে সাথে ‘নারী কলহপ্রিয়’ এবং ‘নারী দুর্বল’ এরকম প্রচলিত নেতিবাচক ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন প্রয়োজন।

১৩. অলীক কিংবা বাস্তবতা বিবর্জিত কোনও বিষয়বস্তু বা চরিত্র নয়, প্রয়োজন জীবনবোধে উজ্জীবিত চরিত্র। বাস্তবতার মুখোমুখী সংগ্রামী সেই সব মা-বোনদের জীবনচিত্র, যা দেখে অনুপ্রাণিত হবে আরও সহস্র কোটি প্রাণ।

১৪.হলুদ সাংবাদিকতার বিরূপ প্রভাবও গণমাধ্যমে মেয়েদের আসার পথকে কণ্টকিত করছে। পত্রিকাগুলো অভিনয়-শিল্পীদের ব্যক্তিগত জীবনে বা কোন ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে চটকদার খবর ছাপিয়ে মূলত অভিভাবকদের শঙ্কিত করে তোলে। অভিনয় যে মর্যাদাসম্পন্ন একটি পেশা কিংবা নারীর ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে এ ধারণা অনেক অভিভাবকেরই নেই। বলা বাহুল্য, আমাদের পত্র-পত্রিকাগুলোর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই অভিভাবকরা ইতিবাচক দিকটির সাথে পরিচিত হতে পারছে না।

১৫. শিল্পীর পারিবারিক, সামাজিক ও কার্যক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা বা যানবাহন সংকট ইত্যাদি সমস্যার অদ্যাবধি কোনো উন্নতিই হয়নি। দু’একটি ক্ষেত্র ছাড়া নারী শিল্পী শুটিং বা রেকর্ডিং শেষে রাতে বাড়ি ফেরার সময় যে বিড়ম্বনার সম্মুখীন হন তা ভুক্তভোগীরাই শুধু বুঝবেন। এক্ষেত্রে শিল্পীটির সঙ্গে যদি তার মা থাকেন সেক্ষেত্রেতো তাঁর বিড়ম্বনার পরিধি আরো বিস্তৃত। বাড়িতে স্বামী বা পিতার নিরব বা সরব অসন্তষ্টি, গেটের চাবি বাড়িওয়ালার কাছে থাকার বিপদ- এ ধরনের নানা উটকো ঝামেলা বা বিপত্তি একজন নবীন শিল্পীকে প্রথমেই কিংবা মধ্যপথে অভিনয়ের পথ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য করে।

১৬. নারী শিল্পী যদি অনেক রাতে তার কাজ শেষ করে একা সেট থেকে বিদায় নেয় তখন অনেকে বলে থাকেন মেয়েটি ভালো না, কারণ মেয়েটি পুরুষের কোনও রকম সাহায্য ছাড়াই একা যাতায়াত করেছেন। একই সেট থেকে যদি মেয়েটি তার কোনও পুরুষ বন্ধুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন, সেখানেও সহকর্মীরা রহস্যের সন্ধান করেন। এক্ষেত্রে মেয়েটির অপরাধ তিনি একজন পুরুষের সঙ্গে অবস্থান ত্যাগ করেছেন।

আমি জানি আমার এই লেখার বিষয়বন্তু অনেক পুরাতন এবং এটা নিয়ে বহু বছর ধরে তর্ক বিতর্ক চলছে। একজন দর্শক হিসাবে অলীক কিংবা বাস্তবতা বিবর্জিত কোনো বিষয়বস্তু বা চরিত্র নয়, চাই জীবনবোধে উজ্জীবিত চরিত্র, চাই বাস্তবের মুখোমুখী সংগ্রামী সেইসব মা-বোনদের জীবনচিত্র, যা দেখে অনুপ্রাণিত হবে আরও সহস্র কোটি মানুষ। আমিও তেমন কোনো চরিত্র কিংবা সংলাপ বলতে বলতে জীবনে আরো একধাপ এগিয়ে যেতে পারবো-‘একটিতো আলো আমার হাতে আছে এটি দিয়েই জ্বালিয়ে যাবো অসংখ্য প্রদীপ।’ অন্যথায় কবির ভাষায়-

“রাঁধার পরে খাওয়া

খাওয়ার পড়ে বাঁধা

এইটুকুতেই জীবনখানি বাঁধা,

এর বেশি আর কিই বা চাইবার থাকে মেয়ে মানুষের”।

 

Salma Ahmed

লেখক: এনসিসি ব্যাংক কর্মকর্তা (খন্ডকালীন শিক্ষক

কমিউনিকেশন এন্ড মিডিয়া স্টাডিস বিভাগ

ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলেপমেন্ট অল্টারনেটিভ)

 

সূত্র- এটিএন টাইমস।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.