Leadসব সংবাদ

টেকনাফের লম্বাবিল সীমান্তে রোহিঙ্গাদের স্রোত

ঢাকা জার্নাল: নাফ নদী পাড় হয়ে টেকনাফ সীমান্তের হোয়াইক্যং লম্বাবিল সীমান্ত দিয়ে বানের স্রোতের মতো ঢুকছে রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের শিকখালী সীমান্ত থেকে বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গাদের এই লম্বা লাইন চোখ যতদূর যায়, ততদূরই দেখা যায়। দীর্ঘ হাঁটা পথে শিশু ও বৃদ্ধদের দেখা গেছে তরুণদের কাঁধে।
রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, কোনও বাধা ছাড়াই তারা ঢুকছেন বাংলাদেশে। নিবন্ধন বা কোনও প্রক্রিয়া ছাড়াই তাদের ঢুকতে দেয়া হচ্ছে। এপারে আসার পর প্রথমেই তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে হালকা খাবার ও পানি। এরপর তারা টেকনাফের হোয়াইক্যং রাস্তায় উঠে বসে থাকেন। সেখান থেকে ট্রাক, অটোরিকশা, পিকআপ করে যাচ্ছেন কক্সবাজারের উখিয়া ও অন্যান্য এলাকায়।
বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) বিকালে সরেজমিনে টেকনাফের লম্বাবিল সীমান্তে এই দৃশ্য দেখা যায়। জেলেদের নৌকায় নাফ নদী পার হয়ে এপারে এসেছেন এসব রোহিঙ্গা। এরপর বিলের মাঝখান দিয়ে পায়ে হেঁটে হোয়াইক্যং ঢুকে পড়ছেন।
মিয়ানমারের নাফপুরা থানার নাইসাপুর থেকে পালিয়ে ৮ দিন ধরে পাহাড় ও জঙ্গল অতিক্রম করে আজ ই (বৃহস্পতিবার) বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন মো. হোসেন (৪৮)।
তিনি বলেন, ‘বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ বাড়ির ওপর দিয়ে হেলিকপ্টার যায়। এরপর গুলি, একটু পরই দাউ দাউ করে বাড়িঘর জ্বলে ওঠে। যেভাবে পেরেছি, বাড়ি থেকে বের হয়ে দৌড়ে এসেছি। দৌড়ানোর সময় মিলিটারিরা ধাওয়া দিয়ে আরও দৌড়াতে বলে।’
মিয়ানমারের শিলখালী বর্ডার দিয়ে পাড় হয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পুরো পরিবার নৌকায় পার হতে বাংলা টাকার ১৫ হাজার দিয়েছি। বাড়িতে আমার পরিবারের আর কেউ নেই। সবাই চলে এসেছে।’

মিয়ানমারে নিজের ১৫ বিগা জমি ট্রাক্টর দিয়ে চাষাবাদ করতেন হোসেন। নিজের ১৫টি গরু ছিল, সব ছেড়ে দিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘কেবল আসা শুরু হয়েছে। এখনও লাখ লাখ মানুষ রয়েছে সীমান্তের ওপারে। আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা নৌকার জন্য অপেক্ষা করছে।’
রশিদা বেগম (২৮) নামে এক নারী বাংলাদেশ সীমানায় ঢুকে হাউমাউ করে কাঁদছেন। তিনি জানান, তার বাবার নাম মোহাম্মদ সিদ্দিক। ছয় বছর আগে তিনি মারা যান। মা দিলবাহার ও ভাই নূর হোসেনের সঙ্গে মংডুর নাইখেরবিল ইউনিয়নে ছিলেন।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী ঘরে আগুন দেওয়ার পর তিনি দৌড়ে পালিয়ে আসেন। সবাই যেদিকে যায়, তিনিও সেদিকে যান। হাঁটতে হাঁটতে বাংলাদেশে এসেছেন। ভাই ও মায়ের খোঁজ না পেয়ে তিনি কাঁদছেন।তার ভাইয়ের মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে।

জাহিদ নামে ১৪/১৫ বছরের এক কিশোর। তার দাদিকে কাঁধে নিয়ে বাংলাদেশ সীমানায় ঢুকেছে। তার দাদির নাম মোস্তফা হাতু (৭০)। তারা জিমংহালির শিলহালি এলাকায় থাকতো। ১৫ দিন সীমান্ত এলাকায় ছিল। নোম্যান্স ল্যাণ্ডে তারা আটকে ছিল।

জাহিদ জানায়, ‘বাড়িতে আগুন দেওয়ার পর সবাই দৌড়ে পালাই। দাদিকেও নিয়ে আসি। দাদি হাঁটতে পারে না, তাই তাকে কাঁধে নিয়ে হেঁটে আসছি।’
আসিয়া খাতুন নামে এক নারী সন্তান কোলে নিয়ে হাঁটছেন আর হাঁপাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘সব জ্বালিয়ে দিয়েছে গুলি করে। পাহাড়ে পালিয়ে ছিলাম। পাহাড়ে পাহাড়ে হেঁটে আসছি।’

রোহিঙ্গাদের কারও হাতেই কোনও ভাড়ি বোঝা নেই। ছোটছোট ব্যাগ দেখা গেছে অনেকের কাছে। বেশিরভাগ মানুষ এককাপড়ে বের হয়ে এসেছেন। আসার পথে পরিবারের অনেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেনস। তাদের খুঁজে পাচ্ছেন না। তা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে তাদের।

গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা চৌকিতে সন্ত্রাসী হামলার পর দেশটির সেনাবাহিনী ওই রাজ্যে অভিযান চালায়। রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের বসত বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে। এজন্য তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন।

ঢাকা জার্নাল, সেপ্টেম্বর ৮, ২০১৭।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.