জঙ্গিদের লাশ নিতে চায় না পরিবার, রাখতে চায় না হাসপাতাল
ঢাকা জার্নাল: সম্প্রতি পুলিশ, র্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত ১৯ জঙ্গির লাশ নিতে চাইছে না তাদের পরিবার। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে রাখতে চাইছে না কর্তৃপক্ষ। তবে পুলিশ জানিয়েছে, সবার ডিএনএ ও কয়েকজনের ড্রাগ টেস্টের রিপোর্ট হাতে পেলে তদন্ত কর্মকর্তা যদি মনে করেন, আর কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার নেই, তারপর এবিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
পরিবার জঙ্গিদের লাশ নিতে আগ্রহ প্রকাশ না করার কারণে দাফন ও হস্তান্তরের বিষয়টিও আটকে আছে।
সোমবার বিকেলে নিহত জঙ্গিদের কয়েজনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা জঙ্গি সন্তান, ভাই ও স্বজনদের লাশ নিতে চান না। পুলিশ যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, তাতে তাদের কোনও আপত্তি নেই।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) জানিয়েছে, গুলশান, কল্যাণপুর, মিরপুর ও নারায়ণগঞ্জে নিহতদের ডিএনএ ও ড্রাগ টেস্টের জন্য নমুনা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইকে দেওয়া হয়েছে। গুলশানের ছয়জনের ডিএনএ টেস্টের ফলাফল আসলেও তাদের ড্রাগ টেস্টের ফল এখনও পাওয়া যায়নি। বাকি কল্যাণপুর ও নারায়ণগঞ্জে নিহত জঙ্গিদের ডিএনএ টেস্ট এখনও হয়নি।
গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে বেকারিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ছয়জঙ্গি নিহত হয়। ২৭ জুলাই কল্যাণপুরে একটি জঙ্গি আস্তানায় নয় জঙ্গি নিহত হয়। ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় জঙ্গি আস্তানায় জেএমবির মাস্টারমাইন্ডসহ তিন জঙ্গি পুলিশের অভিযানে নিহত হয় এবং সর্বশেষ গত ২ সেপ্টেম্বর বৃহত্তর মিরপুরের রূপনগর থানার একটি বাড়িতে জঙ্গি নেতা জাহিদুল ইসলাম ওরফে জাহাঙ্গীর ওরফে মুরাদ নিহত হয়।
এদের মধ্যে গুলশানে নিহত ছয় জঙ্গির লাশ সিএমইএচে। বাকি ১৩ জনের লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। এসব জঙ্গিদের পরিবার ঘটনার পর থেকেই লাশ নিতে অস্বীকার করে আসছে। এদিকে, ঢামেক হাসপাতালের মর্গে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় লাশগুলো দ্রুত পুলিশকে নেওয়ার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিঠি দিয়েছে। তবে পুলিশ চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া জঙ্গিদের মরদেহের বিষয়ে এখনই কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না বলে জানিয়েছে তারা।
ঢাকার কল্যাণপুরে পুলিশের অভিযানে নিহত নয় জঙ্গির মধ্যে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের বল্লভপুর গ্রামের রাজমিস্ত্রি সোহরাব আলীর (৬৫) ছেলে আব্দুল্লাহ। সে গত এক বছর ধরে নিখোঁজ ছিলেন। কল্যাণপুরে অভিযানের পর তারা জানতে পারেন আব্দুল্লাহ জঙ্গি। তার মরদেহে ঢামেক হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। তার পরিবারের সদস্যরাও লাশ নিতে অস্বীকার করেছেন। আব্দুল্লাহর ভাই আবুল কালাম আজাদ অস্বীকারের কথা জানান।
এদিকে, নবাবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আব্দুল্লাহর লাশ তার পরিবারের কেউ নিতে চান না। এমনকী এলাকাবাসীও হুমকি দিয়েছে যাতে জঙ্গিদের লাশ এলাকায় না প্রবেশ করে। সে কারণে আমরাও আগ বাড়িয়ে কিছু করছি না।’
গুলশান হামলায় নিহত সাইফুল চৌকিদারের ভায়রা কবির বলেন, ‘আমরা সাইফুলের লাশ পাওয়ার জন্য একমাস আগে ডিবি অফিসে আবেদন জমা দিয়েছি। আজকেও ডিবি অফিসের কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের সাথে ফোনে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ডিএনএর যে নমুনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে, তার প্রতিবেদন চলে আসলেই লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।’
অপরদিকে, নারায়ণগঞ্জ জঙ্গি আস্তানায় নিহত জেএমবির মাস্টারমাইন্ড তামিম আহমেদ চৌধুরীর লাশও ঢামেক হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। তামিম চৌধুরীর পুরো পরিবার কানাডাপ্রবাসী। তামিমের চাচা নূরুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ভাতিজার মৃত্যুর বিষয়টি তার জানা নেই। এমনকী তার বাবার পরিবারের সঙ্গেও তাদের কোনও যোগাযোগ নেই। তামিম দেশে কোথায় অবস্থান করতো, সে বিষয়েও তারা অবহিত ছিলেন না। লাশও তারা নেবেন না।
কল্যাণপুরে নিহত মো. জোবায়ের হোসেনের (২০) গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সুধারাম থানার পশ্চিম মাইজদী। তারা বাবার নাম আব্দুল কাইয়ূম। মায়ের নাম আয়েরা বেগম। তার লাশও ঢামেক হাসপাতালে রয়েছে। আব্দুল কাইয়ূম বলেন, ‘ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাকে লাশ শনাক্তের জন্য ঢাকায় নিয়েছিল। আমি গিয়েছিলাম। তবে প্রথম থেকেই আমি লাশ আনার পক্ষে নই। এখন ওর মা (আয়েরা বেগম) লাশ নিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। পুলিশ যদি লাশ দেয়, তাহলে নেবো।’
এসব জঙ্গিদের ১৩টি লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। ঢামেক হাসপাতালের মর্গে সাতটি ফ্রিজে আটটি করে মোট ২৮টি লাশ রাখা যায়। বর্তমানে আবার দুটিই ফ্রিজ নষ্ট। নতুন পাঁচটায় ২০টি লাশ রাখা যায়। সেখানে এখন ১৩ জঙ্গির লাশ থাকায় অন্যান্য ঘটনায় নিহতদের লাশ রাখতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। তাই, পুলিশকে তারা চলতি সপ্তাহে জঙ্গিদের লাশ সরিয়ে নিতে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছে। পুলিশ ঢামেক হাসপাতালের চিঠির বিষয়টিও স্বীকার করেছে ।
এবিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘সম্প্রতি পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ১৯ জঙ্গি নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে গুলশানের জঙ্গিদের ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন পেলেও কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মিরপুরের ঘটনায় নিহত ১৩ জঙ্গির প্রতিবেদন এখনও পাওয়া যায়নি।’ তিনি বলেন, ‘নিহত জঙ্গিদের মধ্যে কারও লাশ নেওয়ার জন্য স্বজনেরা আবেদনও করেননি। যদি কেউ তাদের লাশ নিতে চাইতেন, তাহলে স্বজনদের ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হতো। তারপর লাশ দেওয়া হতো।’
মাসুদুর রহমান বলেন, ‘কল্যাণপুরে নিহত নয় জঙ্গির ডিএনএ টেস্টের জন্য নমুনা সিআইডি ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। তার ফলাফল এখনও পাওয়া যায়নি। এসব পরীক্ষার ফলাফল পেলে এবং তদন্ত কর্মকর্তা যদি মনে করেন আর কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার নেই, তারপর যদি কেউ লাশ নিতে চান, তাহলে দেওয়া হবে।’
মাসুদুর রহমান আরও বলেন, ‘গুলশানে নিহত জঙ্গিরা মাদক নিয়েছিল কিনা তা পরীক্ষার জন্য এফবিআই’র কাছে নমুনা দেওয়া হয়েছে। তারও ফলাফল পাওয়া যায়নি। বর্তমানে সিএমএইচে ছয় জনের এবং ঢামেক হাসপাতালের মর্গে ১৩ জঙ্গির লাশ রয়েছে। সম্প্রতি, জঙ্গিদের লাশ নেওয়ার জন্য ডিএমসি পুলিশকে চিঠি দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।’
ঢাকা জার্নাল, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৬।