চিন জাপান পারস্পরিক সম্পর্ক ও বিশ্ব অর্থনীতি
পূর্ব চিন সাগরে কয়েকটি দ্বীপকে কেন্দ্র করে কয়েকমাস আগে চিন-জাপানের মধ্যে চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল৷ তখন বিশ্বের সকলেই ভয় পেতে শুরু করেছিলেন যে হয়ত এই ঘটনাকে ঘিরে এশিয়ার দুই সুপার পাওয়ারের মধ্যে না এবার যুদ্ধ বেঁধে যায়৷ বিশ্বের তাবৎ মিডিয়া এই খবরের দিকে তখন মুখিয়ে ছিল৷
গত মাসে যখন সকলেই ভাবতে শুরু করেছে যে আপাতত দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের উন্মত্ত আগ্রাসী ভাব সরে গিয়ে তারা শান্ত হতে শুরু করেছে ঠিক তখনই ইউনাইটেড স্টেটসের কিছু অফিসার হিলারি ক্লিনটনের কাছে রিপোর্ট জমা দেন৷ এই রিপোর্টে তারা উল্লেখ করেছেন, বিতর্কিত অঞ্চলে এখনও পূর্ণ শান্তি নামে নি, উত্তেজনা থেকে সামরিক পদক্ষেপ শুরু হয়ে যেতে পারে৷ এর মধ্যে যখন চিন ওই উপদ্রুত দ্বীপ অঞ্চলে নৌসেনাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ ও গতিপ্রকৃতির উপর নজর রাখার জন্য তাঁর নৌসেনাকে সেখানে নজরদারি করতে বলবে বলে ঘোষণা করে তখন এই আশঙ্কাতে আরও ইন্ধন জোগায়৷ সমস্ত ঘটনা এখন এমন একটা অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে যে এখন কোনও পক্ষই আর পিছু ফিরতে রাজি নন৷
চিন ও জাপানের মধ্যে লড়াই অবশ্য নতুন কোনও ঘটনা নয়৷ অনেক শতাব্দী জুড়েই এই দুই প্রতিবেশী নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে চলেছে৷ তারা অর্থনীতি, রাজনীতি এবং দরকার মতো সামরিক শত্তিু দিয়ে পরস্পরকের দাবিয়ে রাখতে সবসময়ই চেষ্টা করেছে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জাপানের রাজতন্ত্র তাদের সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিনকে নিজেদের অধীনে রাখার চেষ্টা করেছে৷ 1931 সালে জাপান চিনের ভূখণ্ড অধিকার করেও নেয়৷ 1945 সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত টানা 14 বছর ধরে জাপান চিন ভূখণ্ডে নানা হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালায়, নানা অত্যাচার করে৷ তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে গোটা বিশ্বের আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যায়৷ তখন এই দুই প্রতিবেশীই নিজেদের ভিন্ন রূপে বিশ্বের কাছে আত্মপ্রকাশ ঘটায়৷ তবে তাদের মধ্যে কখনও সুসম্পর্ক তৈরি হয়নি৷ জাপান নিজের একটি ভদ্র ভাল ভাবমূর্তি নিয়ে ভদ্রলোক ধরণের বৈদেশিক নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে৷ যদিও চিন এই সময়ে জাপানকে একহাত শিক্ষা দেওয়ার কথাই ভেবে এসেছে৷ জাপানের ভদ্র ও সহযোগিতামূলক বৈদেশিক নীতি 1950সালের পর থেকে তাদের অর্থনীতিতে বিপুল পরিবর্তন এনে দেয়৷ তারা দ্রুত গতিতে অর্থনীতির সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে৷ 1980 পর্যন্ত জাপানের এই ক্রমাগত উধর্বগতি অব্যাহত ছিল৷ এই সময়ের মধ্যে জাপান বিশ্বের অভিজাত দেশগুলির মধ্যে অন্যতম হিসাবে স্থান করে নেয়৷ এমনকি তৎকালীন সময়ে এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসাবে জি-সেভেন এর অন্তর্ুত্তুও হয়, জি-সেভেন হল বিশ্বের সর্বাধিক উন্নত ও শিল্পে অগ্রগতি সম্পন্ন দেশ৷ এটা সত্যিই খুবই উল্লেখযোগ্য একটা ঘটনা, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একটা দেশ একপ্রকার মারা যেতে বসেছিল সেখানে সেই দেশটিই বিশ্বের অন্যতম শিল্পোন্নত দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করছে এর কয়েক দশকের মধ্যেই৷ এশিয়ার কোনও দেশই নিজেদের এতটা যোগ্য হিসাবে প্রমাণ দিতে পারে নি৷ চিনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নতুন পথে চলা শুরু করে 1949 সালে মাও জে দংয়ের সঙ্গে৷ কমিউনিস্ট পার্টি সমগ্র দেশের প্রশাসনের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করে৷ কিন্তু জাপনের পথ ধরে চিন এগোয়নি৷
চিনও শিল্পের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়৷ কিন্তু তার কাছে প্রথম তিন দশক শুধু সামরিক শত্তিু বৃদ্ধি করতে দেখা যায়৷ এশিয়ার দুই বৃহত্তর শত্তিুর এই ক্রম উত্থান ও পতনের মধ্যে দিয়ে একটা কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এই দুটি দেশ অদূর ভবিষ্যতেও কখনো পরস্পরের হাত ধরে পথ চলতে পারবে না৷
সম্প্রতি জাপানের নেওয়া হঠকারি কাজ হল পূর্ব চিন সাগরে তিনটে বিতর্কিত দ্বীপকে কিনে নেওয়া, এই দ্বীপগুলোকে কেন্দ্র করেই চিন-জাপান সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে৷ জাপানের এই কাজকে চিন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চিনের প্রতি চাপ তৈরি করা বলে বর্ণনা করে৷ এবং পাল্টা হিসাবে চিন তিনটে পর্যবেক্ষণকারী জাহাজকে জাপানের জলসীমার মধ্যে থাকা সিনাকাকু দ্বীপের কাছে পাঠিয়ে দেয়৷ এর প্রতিবাদে জাপানও তাঁর বৈদেশিক নীতিতে আগ্রাসী হয়ে ওঠে ও চিনকে পাল্টা হুমকি দিতে থাকে৷ জাপানের শাসক দল লিবারাল ডেমোক্রাটিক পার্টি ২০০৯ সালে নির্বাচনের আগে ভোটপ্রচারের সময়েই জানিয়েছিল যে তারা ক্ষমতায় এলে আর ইউএস-এর ভয়ে পিছিয়ে না থেকে বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে আরও দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করবে, তারা ইউএস-এর চেষ্টায় দূর প্রাচ্যে যে চিন সহ সব দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চেষ্টা করে সেটাও আর করবে না৷ যদিও ভাগ্যবশত তারা নির্বাচনে জয়ী হলেও তেমন ঘটনা ঘটেনি৷
এই একটা ইসু্যতেই দূরপ্রাচ্যে অস্থিরতার আবহ গড়ে তুলেছে৷ এই দুই দেশই যদি তাদের বৈদেশিক নীতিতে যে স্থৈর্যের পরিচয় এতদিন দিয়ে এসেছে তার ব্যতিক্রম ঘটতে পারার আশঙ্কা রয়েছে৷ দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির সঙ্গে যখন তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির সামরিক সংঘাত তৈরি হবে তখন পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতাবস্থা একেবারে বিনষ্ট হবে৷ শুধু এটুকুতেই যদি সব মিটে যেত তবুও তা উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু নয়, কিন্তু এর ফলে বিশ্বের শত্তিুসাম্য বিনষ্ট হবে৷ চিন-জাপান যদি তাদের আঞ্চলিক স্থিতাবস্থা বজায় না রাখে তাহলে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি থমকে দাঁড়াবে৷ এটা ঠিকই গত শতাব্দীর যে যে ঘটনা এই দুই দেশের মধ্যে ঘটে গেছে তার ফলে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও এখনও তিত্তুতা বজায় রয়েছে৷ কিন্তু সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই বুঝবেন আজকে যদি আবার দুই দেশ তাদের মধ্যে সামরিক প্রতিযোগিতা শুরু করে, তাদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ ঘনিয়ে ওঠে তাহলে সেই বিগত শতকের মতোই এখনকার প্রজন্মও যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নৃশংসতার মুখোমুখি হবে৷
চিন আজকে জাপানের অধিকৃত জলসীমার মধ্যে নিজেদের ড্রোন বাহিনি পাঠাচেছ, চিন কখনোই নরম ভাবাপন্ন দেশ ছিল না৷ এর অন্যদিকে জাপান বরাবর নরমভাবাপন্ন দেশ হিসাবেই থেকেছে৷ এবং তাদের কাছে স্থিতিস্থাপক বৈদেশিক নীতিতে চলাটাই স্বাভাবিক৷ কারণ ইতিমধ্যেই তারা অর্থনীতিতে এতটাই স্বয়ম্ভর হয়ে উঠেছে যে বিশ্বে নিজের ভাবমূর্তি ধরে রাখার প্রয়োজন রয়েছে৷ এই দিকে লক্ষ্য রেখেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপানে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল৷ জাপানের সংবিধানের নবম আর্টিকেল স্থল, জল বা বায়ু সেনাবাহিনী রাখবে না এমনই প্রতিশ্রুতি দেয়৷ এমনকি এখনও পর্যন্ত এই ধারা পরিবর্তন করা হয়নি৷ একে পরিবর্তন করতে চাইলে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন৷ তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অবস্থা এই ধারা পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করে দিচেছ৷ বর্তমান সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যা তাদের সেই দিকেই এগিয়ে দিচেছ৷ সরকার এখন অস্ত্র কেনা-বেচায় আইন শিথিল করছে, মিলিটারি স্পেস স্যাটেলাইটকে অনুমতি দিচেছ৷ বর্তমানে জাপানের সেনাবাহিনী খুবই দক্ষ৷ তারা ইউএস সেনাদের সঙ্গে মহড়াও দিচেছ৷
জাপান ও চিন দুজনেই যতই পরস্পরের প্রতি আক্রোশ প্রকাশ করতে থাকুক না কেন যেহেতু সামরিক শত্তিুর দিক থেকে কেউই পিছিয়ে নেই, তাই তাদের মধ্যে পরস্পরের মধ্যে আক্রমণ করার সম্ভাবনা এখনও ক্ষীণ৷ বাস্তবে যেটা ঘটতে পারে,দুই দেশের সামরিক আক্রোশ মেটাতে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বে৷ তাতে বিশ্বের অর্থনীতির উপকার হবে৷ এর পরে যে ঘটনাটার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে সেটা হল – এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধবে, তবে সেটা সামরিক যুদ্ধ নয়, সেটা হবে অর্থনৈতিক যুদ্ধ৷ জাপানের এই আগ্রাসী সামরিক মনোভাব যখন অর্থনীতির ক্ষেত্রে আসবে তখন এখানকার অর্থনীতির গত দুই দশক ধরে যে ধিকিয়ে ধিকিয়ে চলছে তাতে নতুন প্রাণ আসবে৷ দেশাত্মবোধের কারণে শিল্পের উন্নতির আরও চেষ্টা শুরু হবে৷ শিল্পের ক্ষেত্রে নিত্য-নতুন উদ্ভাবন ঘটতে দেখা যাবে৷ বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রেও জাপান নতুন করে অন্য দেশের আগ্রহ লাভ করবে৷ চিন-জাপানের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে পারবে৷ জাপানের এই সাম্প্রতিক আগ্রাসী মনোভাব এবং একই সঙ্গে নিজের উপর আস্থা জাপানের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ সৃষ্টি করবে৷ নতুন নতুন বিনিয়োগের ফলে দুই দেশের প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে৷ তবে শেষ পর্যন্ত দুই দেশ যদি সামরিক প্রতিযোগিতার বদলে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু করে তাহলে তারাও বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করতে চাইবে৷ এভাবেই উন্নতদেশগুলি পরস্পরের মধ্যে বিনিয়োগ আবার উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে বিনিয়োগ চলতে থাকবে৷ আর অর্থনীতি তো শুধু বিনিয়োগ নয়, তার সঙ্গে রয়েছে প্রযুত্তিুগত উদ্ভাবন, রয়েছে বাণিজ্য প্রভৃতিও৷ তাই সামরিক ধ্যানধারণা থেকে সরে এসে অর্থনীতির চিন্তাভাবনার মধ্যে এগোতে হবে৷ পরিণত অর্থনীতি কখনোই যুদ্ধ চায় না৷ কারণ যুদ্ধ অস্থিরতা তৈরি করে৷ আর এই প্রতিযোগিতাতে উদীয়মান সূর্যের দেশের নতুন করে উদয় ঘটবে৷