গুজব ও অপতথ্য প্রতিরোধে নাগরিক সচেতনতা

জুলাই ৪, ২০২৪
ফাতেমা জান্নাতুল ফেরদৌস সুরভী

ফাতেমা জান্নাতুল ফেরদৌস সুরভী:

 

চতুর্থ শিল্পবিল্পবের যুগে প্রযুক্তির আশীর্বাদপুষ্ট এই পৃথিবীর আধুনিক সন্ত্রাসবাদের এক নতুন অস্ত্র হচ্ছে গুজব।

 

মিথ্যার জালে জড়িয়ে থাকা এই গুজব সত্যকে বিকৃত করে গলাটিপে হত্যা করে। সবসময় আমরা চোখে যা দেখছি, সেটা সত্যি নাও হতে পারে। হতে পারে সেটা সত্যের মুখোশপরা কোনো মিথ্যা বা অপতথ্য। এই অপতথ্যের চোরাস্রোতের বলি হয় হাজারো নিরীহ মানুষ। পদ্মা সেতুকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছেলেধরার গুজব এবং তারই ধারাবাহিকতায় রাজধানীর বাড্ডায় তসলিমা রেনু নামের এক অসহায় মায়ের গণপিটুনিতে মৃত্যু—এই চোরাস্রোতেরই হাজারো ভয়ঙ্কর রূপের এক করুণ রূপ।

গুজব বা অপতথ্য কোনো মতামত নয়, বরং এটি কোনো তথ্য বা সংবাদের অতিরঞ্জিত বা বিকৃত রূপ। সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদকেও গুজব হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আধুনিক যুগে গুজবের প্রধান উৎস ও বাহন হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ডিজিটাল বাংলাদেশের আশীর্বাদে সবার হাতে হাতে মোবাইল-ইন্টারনেট সহজলভ্য করে তুলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের এক ভয়ঙ্কর রূপ হচ্ছে এই অপতথ্য প্রচার এবং গুজব রটনা। তার উপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেনস্) আগমন এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিয়ে গেছে অপব্যবহারের চূড়ান্ত পর্যায়ে। ছবি এডিট, একজনের চেহারা আরেকজনের সঙ্গে যুক্ত করা, কণ্ঠস্বর পাল্টে দেওয়া, এমনকি নিখুঁতভাবে কারও ভিডিও তৈরি করে ফেলাও সম্ভব এই প্রযুক্তির মাধ্যমে। একদল লোক নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে এসব ভুয়া ভিডিও ব্যবহার করে মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি তৈরি করছে। তাছাড়া অনেকেই নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অতীতের কোনো ভিডিয়ো,ছবি বা সংবাদ ব্যবহার করেও গুজবের সূত্রপাত ঘটাচ্ছে।

গুজব রটনার দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমটি হতে পারে অনিচ্ছাকৃতভাবে, যা অবচেতন মনে হয়ে থাকে। আর দ্বিতীয়টি হলো স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। প্রতিপক্ষকে আক্রমণ, ব্যক্তিগত আক্রোশ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি বা রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবমূর্তি নষ্ট করার উদ্দেশ্যে এ ধরনের গুজব ছড়ানো হয়ে থাকে। এছাড়াও বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিউ বাড়ানো ও মনিটাইজেশনের জন্য উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে প্রচার করা হয় নানা অপতথ্য। নীল-সাদা জগতে ভাইরালের নেশায় মুহূর্তেই লাইক-কমেন্ট-শেয়ারের মাধ্যমে এই অপতথ্য পৌঁছে যায় সবার হাতে। ভার্চুয়াল দুনিয়ার দুর্নিবার আকর্ষণে কনটেন্ট ও ডিজিটাল ক্রিয়েটর হওয়ার শর্টকাট উপায় হিসাবে অনেকেই বেছে নেন এই গুজবের পথ। যার ফলে গুজব প্রচারের গতি পূর্বের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

গুজব প্রতিরোধে সরকার সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়নসহ বেশ কিছু প্রচার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত বিকৃত তথ্য তথা গুজব মনিটরিং ও এর সত্যতা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তথ্য অধিদফতরের ‘গুজব প্রতিরোধ ও অবহিতকরণ সেল’ এবং ‘ফ্যাক্ট চেকিং কমিটি’ কাজ করছে। এই ফ্যাক্ট চেকিং কমিটি গুজব প্রতিরোধে নিয়মিত আইকনোটেক্সট ও ভিডিও তৈরি করছে। গুজব প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে এসব আইকনোটেক্সট ও ভিডিয়ো কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। এ ছাড়া গুজব প্রতিরোধে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ-সহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তর কাজ করছে। এর পাশাপাশি গুজবের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, বেসরকারি গণমাধ্যম ও জেলা তথ্য অফিসসমূহ বিভিন্ন প্রচারকৌশল বাস্তবায়ন করছে।

কিন্তু গুজব বা অপতথ্যের এই কালো ছায়া এত দ্রুত ডালপালা ছড়াচ্ছে যে, নাগরিক সচেতনতা ছাড়া সরকারের একার পক্ষে এই ডালপালা ছাঁটাই করা শুধু দুঃসাধ্যই নয়, একেবারে অসম্ভবও বটে। গুজব প্রতিরোধে দেশের প্রতিটি নাগরিককে সচেতন হতে হবে এবং গুজবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ করতে হবে। এই সচেতনতা শুরু করতে হবে নিজের ঘর থেকে। বাস্তব জগতে চায়ের দোকানে শোনা কথা, লোকমুখের উড়ন্ত খবর বা বাতাসে ভেসে বেড়ানো উড়োখবর— সবই হতে পারে গুজবের এক একটি উৎস। তাই হঠাৎ কোনো কথা শোনামাত্রই তা বিশ্বাস করার আগে সত্য-মিথ্য যাচাই করে নেওয়াটা হবে একজন প্রকৃত সচেতন নাগরিকের কাজ। সামাজিক জীবনে গুজব মোকাবিলায় প্রয়োগ করা যেতে পারে সক্রেটিসের ‘ট্রিপল ফিল্টার টেস্ট’ থিউরি। কোনো তথ্য বিশ্বাস করার আগে সেটা সত্য নাকি মিথ্যা, তথ্যদাতা শুভাকাঙ্ক্ষী নাকি শত্রু এবং তথ্যটি প্রয়োজনীয় নাকি অপ্রয়োজনীয়— এই তিন বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়াকেই বলা হয় ট্রিপল ফিল্টার টেস্ট। যা ছাঁকনির মতো অপতথ্য ও গুজবকে দূর করে তথ্যকে পরিশুদ্ধ করে তুলতে সাহায্য করে।

বর্তমান সময়ে গুজবের সবচেয়ে বড়ো উৎস হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। গুজব প্রতিরোধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রাপ্ত কোনো তথ্য সত্য বলে গ্রহণ করার আগে বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে নিতে হবে। সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে কোনো পোস্টে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে গুজবের অন্যতম বড়ো উৎস ‘সংগৃহীত (কালেক্টেড) তথ্য’ ভালোভাবে যাচাই না করে বিশ্বাস করা এবং প্রচার করা হবে চরম বোকামির শামিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কোনো গ্রুপ বা পেজে মিথ্যা বা ভুল তথ্য দেখলে তাৎক্ষণিকভাবে সেই গ্রুপ বা পেজের অ্যাডমিনকে জানিয়ে পোস্টটি সরানোর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে।

প্রচলিত নয় এমন নিউজ সাইট, ওয়েবসাইট বা অনলাইনে প্রাপ্ত তথ্য সত্য বলে ধরে নেওয়ার আগে তা যাচাই  করে নেওয়াটা খুবই জরুরি। সকল ওয়েবপোর্টাল যে অনলাইন পত্রিকা নয়, এই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার এই যুগে এমন হাজারো ‘ভুতুরে পোর্টাল’ রয়েছে যেখানে মনিটাইজেশন, বিজ্ঞাপন ও ভিউ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে মিথ্যা শিরোনামে নানা ধরনের অপতথ্য প্রচার করা হচ্ছে। এসব তথ্যকে সচেতনভাবে এড়িয়ে চলা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। প্রয়োজনে ফ্যাক্ট চেকিং-এর মাধ্যমে অনলাইনে প্রাপ্ত সন্দেহজনক তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। এই ফ্যাক্ট চেকিং হতে পারে ভার্চুয়াল জগতের সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের অন্যতম মাধ্যম।

গুজব-বিরোধী সচেতনতার অন্যতম নিয়ামক হতে পারে ‘মিডিয়া লিটারেসি’ এবং ‘ডিজিটাল লিটারেসি’। অনলাইনে কী করা উচিত, কী করা উচিত না; এই সম্পর্কে সাম্যক ধারণা দেয় মিডিয়া লিটারেসি। অন্যদিকে অনলাইনে ভুল তথ্য চিহ্নিতকরণ-সহ তথ্যপ্রযুক্তি-সংক্রান্ত নানাবিধ সমস্যার সমাধানে ‘ডিজিটাল লিটারেসি’ গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসাবে কাজ করে।

বর্তমান সময়ে ‘গুজব’ একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আধুনিক যুগের নেটিজেনদের ক্রীড়নক হিসাবে ব্যবহার করে গুজব প্রচারকারীরা প্রতিনিয়ত নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে যাচ্ছে, যা নেটিজেনেরা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারছেন না। এই সুযোগে গুজব ‘সুঁচ হয়ে ঢুকে, ফাল হয়ে বেড়ানো’-র মতো সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি বিশ্বদরবারে এক মহামারির মতো জাল বিস্তার করে যাচ্ছে। গুজবের এই জালকে ছিন্ন করতে হলে গুজবের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই আন্দোলনে সকল গুজব ও অপতথ্য দূরীভূত হয়ে এ দেশ হয়ে উঠবে স্বপ্নের, সত্যের, শান্তির এক উন্নত-স্মার্ট বাংলাদেশ।

 

লেখক : বিসিএস তথ্য ক্যাডার কর্মকর্তা এবং তথ্য অফিসার পদে আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রংপুর-এ কর্মরত