গাজায় নিখোঁজ ১৩ হাজার মানুষের ভাগ্যে কী ঘটেছে

মে ২৬, ২০২৪

ঢাকা জার্নাল, আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

গাজায় যখন প্রতিনিয়ত মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, তখনো ১৩ হাজারের বেশি মানুষের কোনো সন্ধান নেই, এক রকম নিখোঁজ তারা। এদের অনেকে হয়তো এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে, কিন্তু অনেক মানবাধিকার সংস্থা বলছে বাকি অনেকেই সম্ভবত ‘গুমের’ শিকার হয়েছেন।

জেনেভা ভিত্তিক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরের মতে, এই অভিযানে হাজার হাজার মানুষ মারা যাওয়ার পাশাপাশি ১৩ হাজারের ওপর ফিলিস্তিনি নিখোঁজ রয়েছে, তাদের কোনো সন্ধানই আর নেই। এই পরিসংখ্যানে কতজন হামাস যোদ্ধা ও কতজন সাধারণ নাগরিক আছে তা আলাদা করা নেই।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা সংস্থার অংশ গাজার সিভিল ডিফেন্সের হিসেবে ১০ হাজারের ওপর মানুষ শুধু এসব ধ্বংস হওয়া ভবনের নিচে চাপা পড়ে আছে। সিভিল ডিফেন্স বলছে তারা তাদের কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে চাপা পড়া শরীর উদ্ধারে কাজ করছেন, কিন্তু তাদের খুবই সাধারণ কিছু যন্ত্রপাতি আছে যাতে প্রায়শই মৃতের শরীরের কাছে পৌঁছানোটা কঠিন হয়ে যায়। এছাড়া আরেকটা শঙ্কাও আছে যে শরীর যদি ভবনের নিচে ওভাবেই পচা অবস্থায় ফেলে রাখা হয়, তাহলে সামনে গরম যখন আরো বাড়বে তখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটতে পারে।

জাতিসংঘের মতে, গাজা উপত্যকা জুড়ে যে পরিমাণ ধ্বংসাবশেষ জমা হয়েছে তার পরিমাণ হবে প্রায় ৩৭ মিলিয়ন টন আর এর নিচে যেরকম শরীর চাপা পড়ে আছে তেমনি প্রায় আরো সাড়ে ৭ হাজার টন অবিস্ফোরিত গোলাবারুদ আছে, যা স্বেচ্ছাসেবক ও ত্রাণকর্মীদের জন্য আরেকটা ভয়াবহ হুমকি।

আহমেদ আবু ডিউক তার ভাই মুস্তাফাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন মাসের পর মাস ধরে। যুদ্ধের কারণে শরণার্থী হওয়া এই পরিবারটি এখন খান ইউনিসের দক্ষিণে নাসের হাসপাতালের সামনের উঠানে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু তারা যখন জানতে পারে যে কাছেই তাদের ঘর আগুনে পুড়ে গিয়েছে, সেটার অবস্থা জানতে ওখানে যান মুস্তাফা। এরপর তিনি আর কখনোই ফিরে আসেননি। আহমেদ বলেন, আমরা যতটা পারি খুঁজেছি, একসময় যেখানে তাদের বাড়ি ছিল সেটা এখন পুড়ে যাওয়া এক ধ্বংসস্তূপ। আশপাশের সব বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অনেক উঁচু উঁচু ভবন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত অ্যাম্বুলেন্স চালক মুস্তাফার খোঁজ চালাতে থাকে পরিবার, হামাস নিয়ন্ত্রিত সিভিল ডিফেন্সের দল ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে যেসব মৃতদেহ উদ্ধার করেছে সেখানে এবং নিকটস্থ গণকবরগুলোতে, কিন্তু তার দেখা পাওয়া যায়নি।

হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এখন পর্যন্ত এই যুদ্ধে যে পরিমাণ মানুষ মারা গিয়েছে সেটি ৩৫ হাজারের বেশি, কিন্তু সংখ্যাটা শুধু হাসপাতাল থেকে যে মৃতের সংখ্যা জানা গেছে তার ওপর ভিত্তি করে। মুস্তাফাদের মতো এমন অনেক পরিবার আছে যারা আসলে জানে না গত সাত মাসে নিখোঁজ হওয়া তাদের প্রিয়জনেরা কোথায় আছে, কেমন আছে। আবদুর রহমান ইয়াঘি নিচে চাপা পড়া তার আত্মীয়ের শরীর বের করতে গিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। মধ্য গাজার দেইর আল বালাহ শহরে তাদের পরিবারের একটি তিনতলা বাড়ি ছিল, ২২ ফেব্রুয়ারি যখন এতে মিসাইল আঘাত হানে তখন তার পরিবারের ৩৬ জন সদস্য সেই বাড়িতে ছিলেন। তিনি জানান, ১৭টা মৃতদেহ তারা উদ্ধার করতে পেরেছেন, এছাড়া শরীরের যেসব অংশবিশেষ পাওয়া গিয়েছে সেগুলো শনাক্ত করা যায়নি। আমরা বাড়িতে থাকা বেশির ভাগ শিশুর মৃতদেহ খুঁজে পাইনি বলেন তিনি।

মধ্য গাজার আরেকটা শহর আল জুয়াইদাতে আরেকটা পরিবার তাদের হারানো সন্তানের সন্ধানে রয়েছে। তাদের ভয় তাদের সন্তানকেও হয়তো ‘গুম’ করা হয়েছে। মোহাম্মদ আলির মা তার সন্তানের একটা ছবি হাতে নিয়ে ততদিন পর্যন্ত খুঁজেছেন যতদিন না তাকে কেউ বলেছে যে তার ছেলেকে আইডিএফ ধরে নিয়ে গিয়েছে। তারা বলছে যে শেষবার জীবিত অবস্থায় তার সঙ্গে দেখা হয়েছে কিন্তু তারা এরপর আর জানে না যে তার কি হয়েছে।

গত ২৩ ডিসেম্বর যখন উত্তর গাজার জাবালিয়ায় মারাত্মক বোমাবর্ষণ শুরু হয়, তখন এই পরিবারটি আশ্রয়ের খোঁজে নিজ বাসা ছেড়ে একটা স্কুলে এসে উঠে, আর সেদিন থেকেই মোহাম্মদের কোনো খোঁজ নেই। মোহাম্মদের স্ত্রী আমানি আলি বলেন, একপর্যায়ে ইসরাইলি সেনারা স্কুলেও ঢুকে পড়ে এবং নারী ও শিশুদের সেখান থেকে চলে যেতে বলে। তিনি বলেন এরপর সেই রাতে সব পুরুষরা তাদের পরিবারের কাছে ফেরত আসলেও মোহাম্মদ আর আসেনি। সে কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই তারা আর জানেন না। আমানি বলছিলেন তিনি বুঝতে পারছেন না যে তার স্বামী কি মারা গিয়েছে নাকি তাকে আইডিএফ ধরে নিয়ে গিয়েছে, আর এ কারণেই তার বেঁচে থাকার একটা ক্ষীণ আশা এখনো রয়ে গিয়েছে তার।

আমানির বিশ্বাস, ‘যদি সে বেঁচে থাকত ও মুক্ত থাকত তাহলে সে ঠিকই আমাদের খুঁজে বের করত।’ হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিবারগুলোর জন্য একটা অনলাইন ফর্ম তৈরি করেছে যেখানে তারা মৃত ও নিখোঁজদের ব্যাপারে জানাতে পারে, যাতে করে ৭ অক্টোবর থেকে যারা নিখোঁজ তাদের ব্যাপারে একটা পরিপূর্ণ তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা যায়। তবে তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে না জানা পর্যন্ত অনেক পরিবারই তাদের প্রিয়জনকে খুঁজে ফিরবে।