শিক্ষা-সংস্কৃতিসব সংবাদ

গাইডের প্রশ্নে এসএসসি পরীক্ষা, তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডর এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন (৩ ফেব্রুয়ারি) অনুষ্ঠিত বাংলা প্রথমপত্রে বাজারের গাইড বইয়ের প্রশ্ন হুবহু দেখা গেছে। সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে আগের বছরের প্রশ্নপত্র বা গাইড বইয়ের প্রশ্নপত্রের সঙ্গে কোনোভাবেই মিল থাকার কথা নয়। অথচ এমনটা কীভাবে হলো তা খুঁজে বের করতে শিক্ষা বোর্ড তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

গাইড বই থেকে প্রায় হুবহু প্রশ্ন তুলে দেওয়া হয়েছে ঢাকা বোর্ডের এসএসসির বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নপত্রে। মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে ৭০ নম্বরের সৃজনশীল। সৃজনশীলের এই ৭০ নম্বরের মধ্যে ৩০ নম্বর এমসিকিউ। বাকি ৪০ নম্বরই প্রায় হুবহু গাইড বই থেকে কমন পড়েছে।

অর্থাৎ ৪০ নম্বরের প্রশ্ন তিন/চার বছর আগের অন্য শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্নের সঙ্গে প্রায় মিল। অথচ পুরনো প্রশ্ন না দেওয়ার বিধান রয়েছে। বিশেষ করে সৃজনশীলের উদ্দীপক অংশের কোনও কিছুই মেলার কথা নয়। এ ঘটনায় শিক্ষাঙ্গণে বইছে সমালোচনার ঝড়। পরিস্থিতি সামাল দিতে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর শিক্ষাবিদরা মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

সূত্র  আরও জানায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করে তদন্ত শুরু করেছে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বোর্ড। ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।  

তিনি বলেন, ‘বাজারের গাইড বই থেকে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেওয়ার অভিযোগটি দেখার পর খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিষয়টি তদন্তে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। জড়িতদের খুঁজে বের করতে কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকা বোর্ডের প্রশ্ন করেছে অন্য বোর্ডের শিক্ষক। চেষ্ঠা করছি ওই প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী শিক্ষককে চিহ্নিত করতে। প্রাথমিকভাবে একটি বোর্ডকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমরা সেই বোর্ডকে সংশ্লিষ্ট প্রশ্নপ্রত্র তাকে হাজির করতে বলা হয়েছে। দু’একদিনের মধ্যে হয়তো নিশ্চিত হওয়া যাবে। আগামী শনি/রবিবারের মধ্যে এই তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যেতে পারে। এটিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।’

সৃজনশীলের বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে সরকার। অথচ বোর্ডের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করার মত উপযুক্ত শিক্ষক তৈরি হয়নি। এখনও তারা নিষিদ্ধ গাইড বই থেকে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন করছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এই চেয়ারম্যান বলেন, ‘এটি চরম লজ্জার। তারপরও বলবো আমাদের প্রশ্ন করার জন্য ভিন্ন মানের শিক্ষক দরকার। সবাইকে দিয়ে প্রশ্ন করানো সম্ভব নয়, সবাই পারেও না। এটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষকদের জন্য চরম অপমানজনক ও বিব্রতকর।’ এসএসসি পরীক্ষার সৃজনশীলের উদ্দীপক অংশ গাইড বই থেকে দিয়ে কঠিন অপরাধ করেছে মন্তব্য করে অধ্যাপক জিয়াউল হক বলেন, ‘এ জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন প্রণেতাকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে। সংশ্লিষ্ট গাইড মালিকদের সঙ্গে কোনও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হবে।’

শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছেন, সৃজনশীল পদ্ধতির উদ্দেশ্যই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীলতা বাড়ানো এবং মুখস্থবিদ্যা ও গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরতা কমানো। এ কারণে পাঠ্য বইয়ে প্রশ্ন দেওয়া থাকে না। যে নমুনা প্রশ্ন থাকে তাও তুলে দেওয়া যায় না। প্রশ্ন উদ্ভাবন করতে হয়। এ কারণে এক পরীক্ষার প্রশ্ন আগের কোনও পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে মিলবে না। কোনও গাইড থেকেও প্রশ্ন কমন পড়বে না। কিন্তু এ বছরও বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন বোর্ডে আসা চারটি সৃজনশীল প্রশ্ন হুবহু ২০২০ সালের ঢাকা বোর্ডের প্রশ্নে সংযোজন করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে শুধু চরিত্রের নাম বদলানো হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে শুধু জ্ঞানমূলক প্রশ্নটি পরিবর্তন করা হয়েছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে কোনও পরিবর্তন না করে হবহু কপি করা হয়েছে।

সৃজনশীল প্রশ্ন-পদ্ধতির গঠনকাঠামো অনুযায়ী এধরনের কাজ নীতিবিরুদ্ধ অপরাধ। আর এই সবগুলো প্রশ্নই বাজারের বিভিন্ন গাইডে (অনুপম, পাঞ্জেরী ও লেকচার) ও টেস্ট পেপারে উত্তরসহ ছাপানো আছে।

জানা গেছে, গত ৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষায় ‘গ’ বিভাগ উপন্যাস অংশের ৯ নম্বর সৃজনশীল প্রশ্নটি কপি করা হয়েছে কুমিল্লা ও সিলেট বোর্ড ২০১৬ সালের  প্রশ্ন থেকে। এক্ষেত্রে  উদ্দীপক ও সংশ্লিষ্ট ৪টি প্রশ্নে কোনও ধরনের পরিবর্তন না করে হবহু কপি করে এ বছরের ৯নং প্রশ্ন হিসেবে সেট করা হয়েছে।

উপন্যাস অংশের সঙ্গে ২০১৭ সালের বাংলা প্রথম পত্রের উপন্যাস অংশের ৮নং প্রশ্নটি এবছরের উপন্যাস অংশের ১০ নং প্রশ্ন হিসেবে সেট করা হয়েছে। যেখানে শুধু ক নং প্রশ্নটি পরিবর্তন করা হয়েছে। বাংলা প্রথমপত্রের ‘ঘ’ বিভাগ নাটক অংশের ১০ নম্বর সৃজনশীল প্রশ্নটি কপি করা হয়েছে ঢাকা বোর্ড ২০১৭ সালের ১০ নম্বর প্রশ্ন থেকে।

এক্ষেত্রেও শুধু জ্ঞানমূলক প্রশ্নটি পরিবর্তন করা হয়েছে। বাকি সব পুরোনো প্রশ্ন থেকে কপি করা হয়েছে। এ বছর বাংলা প্রথমপত্রের ‘গ’ বিভাগ উপন্যাস অংশের ৮ নম্বর সৃজনশীল প্রশ্নটি কপি করা হয়েছে ঢাকা বোর্ড ২০১৭ সালের ৮ নম্বর প্রশ্ন থেকে। এক্ষেত্রেও  উদ্দীপকের চরিত্রের নাম বদলিয়ে ‘নেওয়াজের’ পরিবর্তে ‘সুমন’ রাখা হয়েছে এবং শুধু জ্ঞানমূলক প্রশ্নটি পরিবর্তন করা হয়েছে। বাকি সব পুরোনো প্রশ্ন থেকে কপি করা হয়েছে। বাংলা প্রথমপত্রের ‘ক’ বিভাগ গদ্য অংশের ৩ নম্বর সৃজনশীল প্রশ্নটি কপি করা হয়েছে বরিশাল বোর্ড ২০১৭ সালের ২নম্বর প্রশ্ন থেকে।

তবে এক্ষেত্রে শুধু উদ্দীপকের চরিত্রের নাম বদলিয়ে ‘শিউলীর’ পরিবর্তে ‘পারুল’ করা হয়েছে এবং জ্ঞান ও অনুধাবনমূলক প্রশ্নটি আংশিক পরিবর্তন করা হয়েছে। বাকি সব পুরোনো প্রশ্ন থেকে কপি করা হয়েছে। এছাড়া এমসিকিউ অংশের প্রশ্ন নং ১৯, ২১, ২৩, ২৫, ২৯ ও ৩০-এর একাধিক উত্তর। একটাই সঠিক উত্তর থাকার কথা থাকলেও কোনো কোনোটিতে তিনটি পর্যন্ত সঠিক উত্তর রয়েছে।

গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেওয়ার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা। তাদের মতে, মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় না আসায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মেধাবীদের এ পেশায় আনতে হলে সরকারকে ব্যতিক্রম উদ্যোগ নিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বুধবার বলেন, ‘এটিই হচ্ছে মেধাহীন শিক্ষক নিয়োগের ফল। শিক্ষার্থীদের নকল করার পাশাপাশি এখন শিক্ষকরাও নকল করে বোর্ডের প্রশ্নপত্র তৈরি করছে। তারা গুগলে সার্চ দিয়ে এক ঘন্টার মধ্যে প্রশ্নপত্র তৈরি করছে যা একেবারেই অসম্ভব। যারা বোর্ডের প্রশ্নপত্র তৈরি করেন তারা কেউ মেধা খাটান না। মেধাবী শিক্ষকরা কখনও গাইড বই থেকে প্রশ্ন করেন না। সৃজনশীল পদ্ধতির নামে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা জলে পড়েছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলে হয়তো এমন নজির দেখা যেত না।’

শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেছেন, যারা বাংলার বিষয়ে স্বতন্ত্রভাবে একটা প্রশ্ন করতে পারেন না, তারা শিক্ষা বোর্ড চালান কেমন করে? গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেয়ায় অভিযুক্তদের লজ্জা-শরম নেই, কিছুদিন পরপরই তারা এটা করেন।’