কোটিপতি স্বামীর ঘর করেও কমলা বেগমের লাশ ‘বেওয়ারিশ’
এস এম আব্বাস ।। হাসপাতালে বহির্বিভাগের পেছন দিকে একটি ওয়ার্ডের করিডোরে নির্জন স্থানে কাঁথা দিয়ে স্ট্রেচারের ওপর ঢেকে রাখা হয়েছে কমলা বেগমকে। কান্নাকাটির লোক তো দূরের কথা, মৃত্যুর পরও কোনও নিকটাত্মীয় নেই তার পাশে। ব্রেন স্টোকে অসুস্থ অবস্থায় শনিবার (৭ অক্টোবার) দুপুরে হলি ফ্যামেলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার।
মৃত্যুর পর কোনও নিকটাআত্মীয় লাশ না নেওয়ায় ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবেই দাফনের উদ্যোগ নেন ওই হাসপাতালের সমাজসেবা কর্মকর্তা সামিয়া ইসমৎ সোহেলী।
তিনি বলেন, ‘হাজার কোটি টাকার স্বামীর ঘর করেও কমলা বেগমের লাশ বেওয়ারিশ। দশ বছর ধরে অন্যের দয়ায় বিনা ভাড়ায় থেকেছেন। বয়স্কভাতার অর্থ নিয়ে দু’বেলা খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছেন। সরকারি ও ব্যক্তি সহায়তায় চিকিৎসা নিতে হয়েছে তাকে।’
শনিবার বিকাল চারটায় হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, কমলা বেগমের মৃত্যুর পর বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ দাফনের উদ্যোগ নেন সমাজসেবা কর্মকর্তা সামিয়া ইসমৎ সোহেলী। সোহেলী তার অফিস থেকে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামে ফোন দিচ্ছেন লাশটির দাফনের ব্যবস্থা নিতে। সেখান থেকে জানানো হলো— থানা পুলিশের অনুমতি ছাড়া লাশ নেওয়া সম্ভব নয়।’ ফোন ছেড়ে দিয়ে এবার সোহেলী সাদা কাগজ বের করে আবেদন লিখতে শুরু করেন।
ঠিক তখনই হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষায় থাকা দুই নারী— রামপুরার শেখ মাকছুদা আখতার ও ধানমন্ডির হাসনে আরা অফিসের ভেতরে ঢুকে পড়েন। সমাজসেবা কর্মকর্তাকে শেখ মাকছুদা আখতার বলেন, ‘এতদিন তাকে না জেনেশুনেই তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। মৃত্যুর পর তার লাশটা অন্তত নিজেরাই দাফন করতে পারবো।’
এরপর থেমে যান সমাজসেবা কর্মকর্তা সোহেলী। নতুন করে ভাবতে থাকেন— কিভাবে লাশটি তাদের হাতে তুলে দেওয়া যায়।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সত্তর বছর বয়সী এই কমলা বেগম এক সময় অর্থ-বিত্তের মধ্যেই জীবন-যাপন করেছেন। স্বামী মতিউর রহমান রাজধানীর তোপখানা রোডের ফুলার অ্যান্ড কোম্পানির মালিক। দ্বিতীয় বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়কমলা বেগমের। মতিউর ও কমলা বেগমের প্রথম সন্তান ৫১ বছর বয়সী মিজান বর্তমানে কুমিল্লায় ভারসাম্যহীন জীবন-যাপন করছেন। আর মতিউর রহমান দ্বিতীয় স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে সংসার করছেন। স্বামীর এত কিছু থাকলেও তাকে দাইয়ের কাজ করে নিজের দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জোগাড় করতে হয়েছে একসময়। দশ বছর বিনা পয়সায় টিনসেডের বাড়িতে থেকেছেন খেয়ে না খেয়ে। বয়স্কভাতা নিয়ে স্বচ্ছলভাবে বাঁচতেচেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সমাজ সেবা অধিদফতরের আওতায় পরিচালিত হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রমের মাধ্যমে হলি ফ্যামেলিতে গত ২০ সেপ্টেম্বর ঠাঁই হয় তার।
সোহেলী বলেন, ‘কমলা বেগমের স্বামীর কোটি কোটি টাকা রয়েছে। ফুলার কোম্পানির মালিক তিনি। শুনতে পাচ্ছি কমলা বেগমকে তার স্বামী ডিভোর্স দিয়েছেন। এখন এই নারীর লাশটি নেওয়ার জন্য কাউকে পাচ্ছি না। কমলা বেগমের পরিচিত দুই নারী তার লাশ নিতে চাইছেন।’
কমলা বেগমের সঙ্গে এই দুই নারী সম্পর্ক কী, জানতে চাইলে ধানমন্ডি থেকে আসা হাসনে আরা বলেন, ‘আমার শ্বশুরের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদ নগরে। কমলা বেগমের বাড়িও সেখানে। বিয়ের পর তার সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয় ছিল। তার স্বামীর অনেক টাকা পয়সা আছে। কিন্তু কিভাবে কেন এমন হলো তা জানি না। এখন শুনছি, স্বামী তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। মাসদেড়েক আগে একটি বস্তি থেকে ফোন পেয়ে তার অসুস্থতার কথা জানতে পারি। আমার গাড়িচালক মাহবুবকে দিয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলাম।’
গাড়িচালক মাহবুব বলেন, ‘আমি তাকে গত ২০ সেপ্টেম্বর এই হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। খালাম্মা বিকাশের মাধ্যমে তার চিকিৎসার জন্য টাকাও দিতেন।’
রামপুরা এলাকার শেখ মাকছুদা আখতার বলেন, ‘রামপুরায় দাই এর কাজ করতেন কমলা বেগম। তখন থেকে তাকে চিনি। তিনি বাড়ি ভাড়ার দিতে পারতেন না। তাই আমাদের খিলগাঁওয়ের একটি টিনসেট ঘরে তাকে বিনা টাকায় থাকতে দিয়েছিলাম। তার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ জানতে পেরে তাকে সহযোগিতার জন্য হাসপাতালে এসেছি। এসে দেখি উনি মারা গেছেন। তার এখন কেউ নেই। তার লাশটি পেলে খিলগাঁও কবরস্থানে দাফন করবো।’
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত শনিবার রাত সোয়া ১০টার দিকে হাসপাতালের করিডোরে পড়ে থাকা কমলা বেগমের লাশ নিতে যান রামপুরার শেখ মাকছুদা আখতার। তিনি বলেন, ‘সমাজসেবা অফিসারের সহায়তায় লাশ নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে পুলিশ।’
হলি ফ্যামেলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের সমাজসেবা কর্মকর্তা সামিয়া ইসমৎ সোহেলী রাত সোয়া ১০টার দিকে জানান,পুলিশের অনুমতি নিয়ে লাশ দাফনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।শেখ মাকছুদা আখতার খিলগাঁওয়ে তার (কমলা বেগমের) লাশ দাফনের ব্যবস্থা করেছেন।’
লেখক- বাংলা ট্রিবিউনের সিনিয়র রিপোর্টার।