‘কিছু লোকের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অর্জন মলিন হয়ে যাচ্ছে’
চট্টগ্রাম: কিছু লোকের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনেক বড় বড় অর্জন মলিন হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের কিছু সমালোচনা থাকতেই পারে, থাকাটাই স্বাভাবিক। সত্যি কথা বলতে কি আমাদের মধ্যে সব মানুষই যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবীত তা নয়। আমরা সবাই যে অসাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষ বা আমরা সবাই যে স্বচ্ছ সেই দাবিও করিনা। আমাদের মধ্যেও অনেক মানুষ আছেন যারা এখন যেভাবে চলছেন সেভাবে না চলাটাই উচিৎ। এটার কারণে আমাদের সরকারের বিশেষ করে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অনেক বড় বড় যে অর্জন তা কিছুটা হলেও মলিন হয়ে পড়ে। ’
রোববার (১৩ ডিসেম্বর) চট্টগ্রামে বাতিঘর আয়োজিত ‘আসাদুজ্জামান নূর: অভিনয় ও অন্যান্য’ অনুষ্ঠানে এ বক্তব্য দিয়েছেন মন্ত্রী। কবি ও সাংবাদিক ওমর কায়সারের সঞ্চালনায় চট্টগ্রামের শিক্ষক, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সাংবাদিকসহ বিশিষ্টজনেরা ছিলেন অনুষ্ঠানের দর্শকসারিতে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রীও মাঝে মাঝে আফসোসের সঙ্গে বলেন যে কিছু কিছু মানুষের অপকর্মের জন্য আমাদের এত প্রচেষ্টা, কিছু লোকের জন্য নষ্ট হয়ে যায়। ’
প্রধানমন্ত্রীর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নূর বলেন, আমি যখন বিরোধী দলে ছিলাম তখন তার সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। তখন তাকে একভাবে দেখেছি। এখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও আমি তাকে দেখছি। যে যাই আপনারা ভাবতে পারেন, কিন্তু প্রতিটি বিষয়ে তিনি এতবেশি জানেন, সত্যি সত্যি তিনি খুব বেশি জানেন। এটি কেবিনেট মিটিংয়ে যাওয়া ছাড়া কেউ বুঝতে পারবেন না।
‘এতগুলো মন্ত্রণালয়, প্রতিটি মন্ত্রণালয় সম্পর্কে উনি এত ধারণা রাখেন, মিটিংয়ের যে কার্যপত্র, প্রতিটা কার্যপত্র উনি যে এত গভীরভাবে পড়েন, অনেক সময় আমরা নিজেরাও পড়িনা। এটা আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয় যে এত ব্যবস্ততার মধ্যেও উনি কিভাবে এগুলো মাথায় রাখেন। ’ বলেন নূর।
গণতন্ত্রের চর্চার কথা বলতে গিয়ে মন্ত্রী বলেন, রাজনীতি নিয়ে তো নতুন করে বলার কিছু নেই। আমরা গণতন্ত্রের চর্চার চেষ্টা করছি। কিন্তু গণতন্ত্র যেভাবে বিকশিত হওয়ার কথা ছিল আমাদের দেশে সেটা হয়নি। কারণ এই দেশে এমন কিছু শক্তি এখনও কাজ করছে যারা আমাদের স্বাধীনতাকেই স্বীকার করেনা, অস্তিত্বকে স্বীকার করেনা। যারা এখনও সাম্প্রদায়িকতাকে তাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এরকম একটি পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের বিকাশ হওয়াটা দুরুহ।
‘যারা খুব বেশি নিরপেক্ষ চিন্তা করেন তারা হয়ত আমাদের সমালোচনা করবেন। কিন্তু এই শক্তিগুলোকে মাথায় নিয়ে যে আমাদের চলতে হচ্ছে সেটাও ভাবতে হবে। ’ বলেন নূর।
‘কিন্তু আমরা সবাই চেষ্টা করছি অগ্রসরও হচ্ছি। দেশটা যে এক জায়গায় যে দাঁড়িয়ে আছে তা না। ’ বলেন নূর।
দেশের উন্নয়ন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘অর্থমন্ত্রীর সামনে আমি একদিন এভাবে বলেছিলাম যে, আমি উন্নয়ন বলতে বুঝি যে এখন সভা-সমাবেশে হাততালি কম হয়। অর্থমন্ত্রী আমার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলেন। সভা-সমাবেশে হাততালি কম সেটার সঙ্গে উন্নয়নের কি সম্পর্ক। আমি বললাম হাততালি দেবে কিভাবে, এক হাতে তো মোবাইল। এক হাতে তো আর তালি হয়না। গ্রামে গিয়ে দেখেন সবার হাতে হাতে মোবাইল। মাসে একজন কমপক্ষে তিন’শ থেকে সাত’শ টাকা বিল দেন। গল্পগুজব করার জন্য মানুষ তিন’শ টাকা খরচ করছে। আসলেই বদলে যাচ্ছে মানুষ। ’
তিনি বলেন, আসলে উন্নয়ন তো দেখা যায়না। রাজনীতি যখন শুরু করেছি তখন গ্রামে গেলে খেতে দিত চিড়া-মুড়ি, লেবুর শরবত। এখন গেলে দেয় চিপস-চানাচুর আর কোল্ড ড্রিংকস, আপেল-আঙুর। ছোটবেলায় কারও বাড়িতে কেউ আঙুর নিয়ে ঢুকলে ভাবতাম যে ওই বাড়িতে মনে হয় কারও শেষ অবস্থা, মৃত্যুর আগে তার শেষ ইচ্ছা হয়েছে আঙুর খাওয়ার, সেজন্য নিয়ে যাচ্ছে। আর এখন অবস্থা এমন হয়েছে আঙুর খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি।
‘আসলে আমরা বদলে যাচ্ছি কিন্তু বোঝা যাচ্ছেনা। এটা অনেকটা বাতাসের মধ্যে থাকলে যে বোঝা যায়না আমরা নি:শ্বাস নিচ্ছি সেরকম। উন্নয়নও সেরকমই। উন্নয়নটা আমরা ঠিক বুঝিনা কিন্তু উন্নয়ন না হলে বুঝি। যদি রাস্তাটা হয়ে যায় তখন মাথায় থাকেনা কিন্তু রাস্তাটা যখন ভাঙা থাকে তখন বুঝি। তো, যাই হোক আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। ’
উত্তরাঞ্চলের মঙ্গার কথা বলতে গিয়ে নীলফামারি থেকে নির্বাচিত এই সংসদ সদস্য বলেন, আমাদের অঞ্চলে একটা কথা ছিল যে, হাতি ঠেলা যায় কিন্তু কার্তিক ঠেলা যায়না। কার্তিক মাসটা কিছুতেই পার হতে চায়না। ঘরে ঘরে প্রচন্ড অভাব। অভাব মানে কী, অভাব মানে তো ধানচালের অভাব হতনা। সবই থাকত, চাল ডাল সব পাওয়া যেত কিন্তু দুর্ভিক্ষ হতো।
‘দুর্ভিক্ষ কেন হতো, কারণ মানুষের পকেটে পয়সা থাকত না। কারণ আশ্বিন মাসে ধান লাগানো হয়ে যেত। তো আশ্বিন, কার্তিক পার হয়ে অগ্রহায়ণ মাসের শেষে গিয়ে ধান কাটা হত। মাঝখানের তিন মাস মানুষের হাতে কোন কাজ থাকত না। কাজ নেই তো মানুষের পকেটে পয়সাও থাকত না। পকেটে পয়সা নেই, তারা কিছু কিনতে পারতনা। এই সময়টাই আসত মঙ্গা। এই মঙ্গার সময় মানুষ মারাও যেত, বেশ মানুষ মারা যেত। ’ বলেন নূর।
‘কিন্তু সেই অবস্থা এখন আর নেই। থাকলে কি মিডিয়ার বন্ধুরা আমাদের ছেড়ে দিতো, একেবারে তুলোধুনো করে ছেড়ে দিত। ’ হাসতে হাসতে বলেন মন্ত্রী।
দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাতিঘর খ্যাতিমান নাট্যাভিনেতা ও রাজনীতিক আসাদুজ্জামান নূরকে নিয়ে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের শেষে বাতিঘরের বই উৎসবের উদ্বোধন করেন মন্ত্রী।