কাচের ভবন নির্মাণে পরিবেশ বিপর্যয়, নেই কোন নীতিমালা

মে ১৬, ২০২৪

সৌম্যব্রত, ঢাকা জার্নাল

কাচঘেরা ভবন দেশের আবহাওয়া ও পরিবেশের উপযোগী না হলেও রাজধানীসহ দেশের মহানগরীগুলোতে একের পর এক নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন। শুধু নতুন ভবনই নয়, পুরোনো ভবনের সৌন্দর্য বাড়াতেও দেয়ালে কাচ লাগানো হচ্ছে। যা চারপাশের পরিবেশকে উত্তপ্ত করে তুলছে। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালের অসহনীয় তাপপ্রবাহে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে এসব কাচের ভবন। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, কাচের ভবন নির্মানের কোনো নীতিমালা না থাকায় প্রতিযোগিতা দিয়ে বাড়ছে এসব ভবন নির্মাণ।

ভবন সংশ্লিষ্টরা জানান, নগরীর ধুলা-ময়লা আর শব্দদূষণ থেকে বাঁচতে তারা ভবনে কংক্রিটের দেয়ালের পরিবর্তে কাচ ব্যবহার করেন। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ভবন নির্মাণ ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বাড়াতে কাচের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন তারা।

তথ্য মতে, ১৯২৮ সালে বিশ্বে প্রথম কাচের দেয়ালের ব্যবহার শুরু হয়,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এর ব্যবহার বাড়তে থাকে। এদেশে প্রথম কাচের দেয়ালের ব্যবহার হয় ১৯৮৫ সালে, মতিঝিলে সেনাকল্যাণ ভবন নির্মাণে। এরপর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভবন নির্মাণে কাচের দেয়ালের ব্যবহার বাড়তে থাকে।

রাজধানীতে এ ধরনের কতগুলো ভবন আছে তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ও ইন্টেরিয়র প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নান্দনিক সৌন্দর্য এবং প্রাকৃতিক আলো ব্যবহার- এসব কারণে ভবনে কংক্রিটের দেয়ালের পরিবর্তে কাচ ব্যবহার বেড়েছে। তবে মূলত বাণিজ্যিক ভবনেই কাচের চাহিদা বেশি।

ভবন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সিম প্রপার্টিজের কর্ণধার মিজানুর রহমান বলেন, ভবনের সৌন্দর্য ও কাচ ব্যবহারের কারণে ভবনে সূর্যের আলো পাওয়া যাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে পরিবেশের ক্ষতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গ্রাহকরা যে যেভাবে চাচ্ছে সেভাবে আমরা ভবন বানিয়ে দেই।

রাজধানীর গুলশান, বনানী, উত্তরা, পল্টন, মতিঝিল, কারওয়ান বাজার মতো বাণিজ্যিক এলাকায় সে কারণেই স্বাভাবিকের চেয়ে তাপমাত্রা বেশি বলে উঠে এসেছে গবেষণায়। এসব ভবনের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে রোদের ঝলক লাগে। কখনও কখনও তীব্র রোদ ঠিকরে পড়ে পথচারীদের চোখে মুখে। অন্যান্য ভবনের চেয়ে এসব ভবনের আশপাশে তাপমাত্রা অনেক বেশি। তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করে দেখা গেছে, অন্য অংশের চেয়ে এসব ভবনের পাশে তাপমাত্রা অন্তত ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ‘ঢাকার দাবদাহ: নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার দায় ও করণীয়’ শীর্ষক পরিকল্পনা সংলাপে বিআইপির সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ শেখ মোহাম্মদ মেহেদি আহসান জানান, কাচের ভবনের মূল সমস্যা হচ্ছে এটা প্রচুর তাপ শোষণ করে। আরবান হিট বাড়াচ্ছে এই কাচের ভবন। যেসব দেশে কাচের ব্যবহার বেশি- সেগুলো আসলে শীতের দেশ। আমাদের দেশে ব্যাপারটা এমন নয়। বাইরের দেশ থেকে এটা আমরা কপি করছি। এটা আমাদের পরিবেশের জন্য ভালো নয়। ঢাকাসহ অনেক জায়গায় তাপমাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে গেছে, অনেক রোগবালাইও বাড়ছে। আমরা যদি তাপ না কমাতে পারি তাহলে তা জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকিতে ফেলবে। এজন্য পরিবেশবান্ধব নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারে উৎসাহিত করতে ইমারত বিধিমালায় উদ্যোগ(নীতিমালা) নিতে হবে।

অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল- এই ২০ বছরে ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে ২ দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া চট্টগ্রামে বেড়েছে ১ দশমিক ৯২ ডিগ্রি, খুলনায় ১ দশমিক ২৭, সিলেটে ১ দশমিক ১, রাজশাহীতে বেড়েছে সবচেয়ে কম শূন্য দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাবেক সাধারণ সম্পাদাক শরীফ জামিলের মতে, কাচের ভবনগুলোতে এসি লাগাতে হয়। এসি ফসিল ফুয়েল ব্যবহার করে, আর গ্যাস ছাড়ে। এটা ওজনস্তরের ক্ষয়ের জন্য দায়ী। সিএফসি, এইচএফসি গ্যাস বাড়ায় নগরের তাপমাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। কাচের ভবনের অনেক খারাপ প্রভাব আছে।

তিনি বলেন, আমাদের ইমারত বিধিমালায় এ বিষয়ে কিছু বলা নেই। আবার নতুন ড্যাপে (বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায়) এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ আছে বলে জানা নেই। ভবন কে কীভাবে নির্মাণ করবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় কাচের ব্যবহার আসলে বাড়ছে।

রাজউকের মুখপাত্র ও প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, নগরের কিছু দর্শন পরিবর্তন করতে হবে। ছোট বড় সব প্লটের ছেড়ে দেওয়া জায়গায় গাছ লাগাতে হবে, তা না হলে বর্তমান সংকট(তীব্র তাপদাহ) থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না। আবাসকি ও বাণিজ্যিক ভবনে এখন উন্নত বিশ্বের আদলে কাচ ব্যবহার করা হচ্ছে। এটার সুবিধা হলো কম খরচে নির্মাণ করা যায়। আর অসুবিধা হলো সূর্যের তাপ বেশি শোষণ করায় এসি ব্যবহার করতে হয়। এয়ার ভেন্টিলেশন না থাকায় সারাক্ষণ এসি ব্যবহার করতে হয়। এসি ব্যবহারে গ্রিন হাউজে প্রভাব পড়ে।

তিনি আরও বলেন, কাচওয়ালা ভবন নির্মাণ ব্যক্তি পর্যায়ে ও সরকারি পর্যায়ে বানানো হচ্ছে এমনকি রাজউক নিজেই কাচওয়ালা ভবন নির্মাণ করছে। সুতরাং সরকারি ভবনগুলোকে আগে পরিবেশ বান্ধব করতে হবে। তারপর আমরা অন্যান্য জাযগায় কাচওয়ালা ভবন নির্মাণে নিরুৎসাহিত করতে পারবো।

বর্তমান ইমারত বিধিমালায় কাচওয়ালা ভবন নির্মাণে কেউ আইনগত নিষিদ্ধ করা দেওয়া বা কেউকে নিরুৎসাহিত করার কোনো আইন নেই। এর জন্য বর্তমান ইমারত বিধিমালা সংশোধন করার প্রয়োজন।