Lead

এক মাসের বড় অর্জন দৃশ্যমান অর্থনৈতিক নেতৃত্ব

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

এক মাস পেরিয়েছে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তী সরকারের। বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়নস্ত্রণে আনা। তবে আলোচনায় বেশি বেশি করে এসেছে অর্থনীতির প্রসঙ্গ।

কয়েক বছরের ধরেই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ নাজুক। শেখ হাসিনা সরকারের প্রশ্রয় আর উদাসীনতায় এস আলম, সালমান এফ রহমান সহ বেশ কয়েকজন বড় বানিজ্যিক দুর্বৃত্ত তৈরি হয়েছিল যারা সমান্তরাল সরকার হিসেবে পুরো আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বিদেশে অর্থপাচার করে করেছে, সামগ্রিক অর্থনীতিতে বড় সংকট তৈরি করেছে।

ডলারের তীব্র সংকট, খেলাপী ঋণের বোঝা এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়েই গত প্রায় ৩ বছর ধরে চলছিল অর্থনীতি। অন্তর্বর্তী সরকারের ঘাড়ে এখন সাড়ে ১৮ লাখ কোটি টাকার ঋণ যার স্রষ্টা শেখ হাসিনার সরকার।

ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এখন সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ দুটোই হলো অর্থনীতিতে ন্যায্যতা ফিরিয়ে আনা। সেটা করতে পারলেই সুবাতাস বইবে বলে আশাবাদ চারদিকে। এই সরকারের নেয়া কিছু কিছু পদক্ষেপ সে কথাই বলছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিতে সরকার নীতি সুদহার কিছুটা বাড়িয়েছে। এতে অবশ্য উচ্চ মূল্যস্ফীতি খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসবে না,কিন্তু পদক্ষেপ ইতিবাচক। সার্বিক মূল্যস্ফীতি গত এক বছরের বেশি সময় ধরে ৯ শতাংশের ওপরে আছে। এর মধ্যে গত জুলাইয়ে ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

শেখ হাসিনার শাসনামলের প্রায় পুরো সময়টাতেই দেশে কোন অর্থনৈতিক নেতৃত্ব দৃশ্যমান ছিল না। অর্থমন্ত্রী,বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর–এরা পুতুলের মতো কাজ করেছেন এস আলম আর সালমানদের নির্দেশে। সে জায়গায় বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরের কাজ এখন অনেক বেশি দৃশ্যমান। ব্যাংকিং খাত, পণ্য বাজার এস আলম মুক্ত হওয়াই একটি বড় সংস্কার বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

নীতি সংস্কারের প্রথম বড় পদক্ষেপ কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল করা।  জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে ঢালাওভাবে অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এর কারণ হিসেবে দেশের প্রধান রাজস্ব আদায়কারী সংস্থাটি বলছে, ‘একটি ন্যায়নিষ্ঠ সমতাভিত্তিক কর ব্যবস্থার’ জন্য এমন সুযোগ ‘বৈষম্যমূলক’। আগের সরকার অর্থনীতিবিদ ও সাধারণ করদাতাদের সমালোচনার পরও চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিনাপ্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ,নগদ টাকা এবং শেয়ারসহ যেকোন বিনিয়োগ ১৫ শতাংশ কর দিয়ে তা বৈধ করার সুযোগ দেয়।

আরেকটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে জ্বালানি খাতে। নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণের আইন বাতিল করেছে অন্তবর্তী সরকার। এর ফলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণের একক ক্ষমতা ফিরে পেল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গত বছর হঠাৎ করে আইন সংশোধন করে নির্বাহী আদেশে দাম সমন্বয় (কম/বেশি) করার বিধান যুক্ত করা হয়। এরপর থেকে নির্বাহী আদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করায় কার্যত বেকার হয়ে পড়ে আধা-বিচারিক প্রতিষ্ঠানটি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অনিয়ম দুর্নীতি খুঁজে বের করতে এ খাতের ‘দায়মুক্তি আইন’ও স্থগিত করা হয়েছে।

রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এবং গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকসহ অন্তত আটটি ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল এস আলম গ্রুপ। অন্য ব্যাংকগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক,ইউনিয়ন ব্যাংক,গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক,আল–আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক। কেন্দ্রীয় এসব ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন পর্ষদ গঠনের মাধ্যমে এসব ব্যাংক এস আলমমুক্ত করেছে। ভেঙে দেওয়া হয়েছে আরও কয়েকটি ব্যাংকের পর্ষদ,যেগুলো সরকার-ঘনিষ্ঠরা নিয়ন্ত্রণ করত।

বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। যেভাবে গাজী টায়ারে বারবার আগুন দেওয়া হলো, লুট করা হলো তা একদিকে যেমন বেদনার, তেমনি বিস্ময়করও যে কেমন করে সম্ভব হলো এমনটা করা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আনায় শিল্প খাতে, বিশেষ তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বাজারঘাটে চাঁদাবাজিও বন্ধ হয়নি। চাঁদা নেওয়া পার্টির রঙ বদল হয়েছে মাত্র।

মূল্যস্ফীতি নিয়ে এখনও কোন আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি,রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ব্যাংক,এনবিআর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করলে নিশ্চয়ই সামনের দিনগুলোতে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে।