একটি আগাম নির্বাচনী কল্প-গল্প || বিভুরঞ্জন সরকার
এলাকা থেকে ছোট বেলার এক বন্ধু ফোন করে প্রথমেই জানতে চাইলো, আমার মাথায় ভোটের পোকা চেপেছে কিনা। খুব ভাবনা-চিন্তা না করেই জবাব দিলাম, একটু একটু শখ হচ্ছে। এ জীবন বড় ক্লান্তিকর মনে হচ্ছে। একবার এমপি-টেমপি হতে পারলে সব দুঃখ খুঁচে যাবে।
বন্ধু আমার কথা বলে না। আমার জবাব শুনে একেবারে চুপ। কিছুক্ষণ পর দম নিয়ে বললো, নির্বাচন করার মতো টাকা আছে তোর? তাছাড়া তোকে নমিনেশন দেবে কে?
আমাকে মজায় পেয়ে বসলো। বললাম, এবার নির্বাচন করতে টাকা লাগবে না। আর আমাকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি – এই তিন দলই নমিনেশন দেবে। যদি কেউ না-ই দেয়, তাহলে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে লড়বো।
তোর কি মাথাটাথা খারাপ হয়েছে? বন্ধু বলে, কে বলেছে নির্বাচন করতে টাকা লাগবে না? টাকা ছাড়া এখন কিছু হয়? জেলা পরিষদ নির্বাচনেও এবার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছে কোনো কোনো প্রার্থী। আর তিন দল তোকে নমিনেশন দিবে, মানেটা কি? নির্বাচন করতে হলে এলাকার সঙ্গে, এলাকার মানুষজনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে হয়। তোরতো এসব নেই। তাহলে? হেয়ালি না করে সত্যি কথাটা বল।
আমি বলি, একদম হেয়ালি করছি না। দেশের রাজনীতিতে ভালো মানুষের আকাল চলছে। এটা আমার কথা না। ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন। তিনি তোর-আমার মতো যে-সে লোক নন। একেবারে সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেছেন, মেধাবী, সৎ এবং ভালো মানুষরা রাজনীতিতে না এলে রাজনীতি খারাপ মানুষদের দখলে চলে যাবে। একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে সেটা আমি হতে দিতে পারি না। তাই আমি রাজনীতিতে যোগ দিবো। কারণ আমি নিজেকে মেধাবী, সৎ এবং ভালো মানুষ বলে মনে করি। দরকার হলে এরপক্ষে আমি অনেক সার্টিফিকেট জমা দিবো। আমাকে নমিনেশন না দিলে আমি উচ্চ আদালতে মামলা করবো ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলার অভিযোগে। তার মিথ্যাভাষণ আমাকে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমি আমার পরিবারকে আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছি। তারা খুব খুশি। তাকে মানুষ এমপি সাহেবের বউ বলবে। উফ! ভাবা যায়। ছেলে-মেয়েও খুশি। তাদের চাকরিবাকরির তদবিরের জন্য বাইরে যেতে হবে না। — আমাকে নমিনেশন না দিয়ে পরিবারের সদস্যদের কাছে আমাকে হেয় করা হয়েছে। অন্য যাদের আমার রাজনীতিতে নামা ও নির্বাচন করার বিষয়টি বলেছি, তারা আমাকে টিটকারি দিচ্ছে। এই সামগ্রিক অবস্থা বিচার-বিবেচনা করে মাননীয় আদালত আমার পক্ষে রায় দেবেন। তখন আলীগ আমাকে নমিনেশন না দিয়ে পারবে না। আর একবার নমিনেশন দিয়ে দিলে দলেরই দায়িত্ব হবে আমাকে জিতিয়ে আনা। আমি হারলেতো দলের ক্ষতি। আমার টাকা নেই, তাতে কি? দলেরতো আছে। ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি ছাত্রলীগারদের বলেছেন, টাকা লাগলে আমার কাছে আসবা। এমন একটা উন্মুক্ত আহ্বানের পরও লীগার না হওয়ায় তার কাছে টাকার জন্য যেতে পারছি না। লীগার হয়ে গেলে এই সমস্যা থাকবে না।
আমার কথায় বন্ধু অবাক নির্বাক হতবাক। মুখ দিয়ে তার কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না। টের পেয়ে আমি জানতে চাই, কিরে চুপ মেরে গেলি কেন? আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?
বন্ধু বলে, একজন সিটিং এমপিকে বাদ দিয়ে তোকে নমিনেশন দিলে এমপির সমর্থকরা তা মানবে?
বর্তমান এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর যা পাওয়ার তা পেয়েছেন। তার অর্থ-সম্পদ কমেনি, বেড়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেকবার বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশের মানুষ কিছু না কিছু পায়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সত্য প্রমাণ করার জন্য হলেও এবার প্রার্থী বদল করতে হবে। সিটিং এমপি এবং তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা কিছু পেয়েছেন। সেজন্য না পাওয়ার দল থেকেই এবার নমিনেশন দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমার নমিনেশন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আমার বন্ধু ফিস ফিস করে বলে, এসব আর কাউকে বলিস না। জানাজানি হলে এমপির লোকেরা তোকে মারধর করতে পারে।
বন্ধুকে অভয় দিয়ে বলি, আরে তুই কি মনে করিস আমার খুঁটির জোর এত দুর্বল? এমপির আর লোক কয়জন। আমার লোক তো দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে।
বন্ধু ঘাবড়ে গিয়ে বলে, ঠিক আছে, আজকে রাখি।
সে কি, বিএনপি আমাকে কেন নমিনেশন দেবে, সেটা শুনবি না?
আজ থাক। আরেকদিন শোনা যাবে। বন্ধু লাইন কাটতে চায়।
আমি বলি, বিএনপির কথাটা একবার শোন।
অনিচ্ছায় ঢেকি গেলার মতো বন্ধু বলে, বল।
বিএনপির সম্ভাব্য ক্যান্ডিডেট, সাবেক এমপি সম্প্রতি মৃত্যুবরণ করেছেন। তাই তাদের প্রার্থী সংকট আছে। সাবেক এমপি আগে সিপিবি করতেন। আমিও তাই। সেজন্য আমি যদি ইচ্ছা প্রকাশ করি, তাহলে বিএনপির তো খুশি হওয়ারই কথা।
বন্ধু বলে, তুই শেষ পর্য়ন্ত বিএনপি করবি? বিএনপি একটি সাম্প্রদায়িক দল। ২০০১-এর নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত সংখ্যালঘুদের ওপর কি অত্যাচার-নির্যাতন করেছিল, সেটা ভুলে গেলি?
আমি বলি, কিছুই ভুলিনি। আগে মনে হতো অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে হিন্দুরা নিরাপদ থাকবে। কিন্তু এবার কি দেখলাম? আওয়ামী লীগ পাওয়ারে থাকলেও হিন্দুরা অনিরাপদ। আওয়ামী লীগ যদি বদলে যেতে পারে, তাহলে আমার বদলাতে অসুবিধা কোথায়? আওয়ামী লীগ যদি হেফাজতের সঙ্গে মিশতে পারে তাহলে আমার বিএনপির সঙ্গে মিশলে দোষ কোথায়?
বন্ধু বললো, একটু বন্ধুয়ানীকে ( আমার স্ত্রী ) ফোনটা দেতো। তোর সঙ্গে আবার পরে কথা বলবো।
আমি ফোনটা আমার স্ত্রীকে দিলাম। বন্ধু যে তাকে কি বললো সেটা আমি শুনতে পারলাম না। শুধু দেখলাম গিন্নির মুখটা হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। ফোন রেখে ডাক্তার কন্যার সঙ্গে কি সব কথা বলতে লাগলো আমাকে না শুনিয়ে।
লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট