মত-অমত

আমার নীরবতা, আমার ভালভাষা

thinking_ladey_sউজ্জয়িনী মুখোপাধ্যায়, কোলকাতা: যেমন শব্দের কাছে নীরবতা ঋণী, যেমন নীরব ফুল সব বন্দনার চেয়ে শ্রেষ্ঠ- তেমনই কি নীরবতায় ছড়িয়ে থাকে ভালবাসার বহির্প্রকাশ? কবিরা অনেক সময়েই নীরবতাকে ভালবাসার স্বস্তির সঙ্গে তুলনা করেন। তাঁদের কাছে নীরবতা মানে পরস্পরকে স্পষ্টভাবে চিনে যাওয়াই। অমিতাভ দাশগুপ্ত যেমন বলেন, ‘আমার নীরবতা আমার ভাষা’। আবার জয় গোস্বামী বলেন, ‘হরিণদের কথা/জানুক নীরবতা’। রবীন্দ্রনাথের কবিতার জগতেও নীরবতায় লুকিয়ে থাকে প্রেম- ‘এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে’। জেন-ওয়াই কিন্তু নীরবতা আর ভালবাসার সমীকরণ নিয়ে বেশ চিন্তিত। দ্বিধাগ্রস্থ বললেও ভুল হয় না। চলতি সময়ে ভালবাসার সম্পর্ক টিঁকে থাকার মেয়াদ যে নেহাতই কম! ভালবাসা ব্যস্ত জীবনদৌড়ের মাঝে পড়ে শুধু যেন ‘যত দিন থাকা যায়’ হিসেবেই উঠে আসে হাতে। তার মাঝে এবার নীরবতা থাকলে মানেটা কী দাঁড়ায়? গভীর ভালবাসা, না সুসময় ফুরিয়ে আসার আগাম ইঙ্গিত? প্রশ্নটা হাওয়ায় চাউর করে দিতেই ভেসে এল নানান উত্তর।

এই শহরের এক কর্পোরেট-কর্মী তিয়াসা গুহ খুব নির্মমভাবে জানালেন, তাঁর এক সময়ের সম্পর্ককে কীভাবে গ্রাস করেছিল নীরবতা। ‘আমি তখন সবে চাকরিতে ঢুকেছি। সারা দিন কাজ সেরে সন্ধেবেলায় বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে চরে বেড়ানো- রুটিন বলতে এই-ই! সেই কলেজ থেকেই আমি আর অভীক এরকমভাবে রোজ সন্ধ্যায় দেখা করতে অভ্যস্ত। এমনিতেই অনেক দিন একসঙ্গে কেটে যাওয়ায় আমাদের মধ্যে অনর্গল কথা বলার ব্যাপারটা কম ছিল। আমার সেটা এমন কিছু অস্বাভাবিকও মনে হয়নি। আস্তে আস্তে কিন্তু সমস্যা দেখা দিল। অভীক আমায় নিয়ে বোর হয়ে গিয়েছিল। শেষ যে দিন আমাদের দেখা হয়, পুরো সময়টাই আমরা চুপচাপ পায়চারি করছিলাম এ রাস্তায়, সে রাস্তায়। ঘন্টাদুয়েকের মধ্যে কথা হয়েছিল হার্ডলি চার-পাঁচ বার। বাস্তবের দাবি মেনে নিয়ে, ওই নীরবতাকে প্রাধান্য দিয়ে বলতে পারেন, আমরা আলাদা হয়ে যাই। ওই নীরবতা দিনের পর দিন সহ্য করা যায় না’, খুব আস্তে-সুস্থে কথাগুলো বলে গেল তিয়াসা।

মনোবিদ অভিরুচি চট্টোপাধ্যায় কিছুটা সমর্থন করছেন তিয়াসার বক্তব্যকে। তিনি মানছেন যে, নীরবতা মানে অনেক সময়েই ভালবাসা না-থাকা। ‘আমাদের কাছে মাঝেসাঝেই আজকাল একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার নিয়ে মানুষজন আসেন। তাঁরা কথা বলার ইচ্ছেটা হারিয়ে ফেলছেন। বেশির ভাগ সময়েই তাঁরা চুপ করে থাকেন। বার বার জিগ্যেস করলে হয়তো একটা কি দুটো কথা বলেন নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বে। এই দিক দিয়ে কারণ খুঁজতে গেলে জীবনের প্রতি ভালবাসা তাঁদের প্রায় ফুরিয়ে এসেছে বলা যায়। তাঁরা নিস্পৃহ হয়ে পড়ছেন জীবন নিয়ে। তাই কথা বলে নিজেকে প্রকাশ করার উৎসাহটুকু পাচ্ছেন না। দু’জন মানুষের মধ্যে যখন নীরবতা নেমে আসে, তখন তার কারণটা হতে পারে এই উৎসাহের অভাব। তার মানেই ভালবাসা নেই’, জানাচ্ছেন অভিরুচি।

এই বক্তব্যেরই উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছে প্রেসিডেন্সির ইতিহাসের ছাত্রী সাহানা রায়। তার প্রেমটাও বেশ নীরব, চাকরির জন্য সৌভিক তাকে ছেড়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে অন্য শহরে। কথায় কথায়, এই নীরবতাই কেমন করে এক রাতে সমাধান করেছিল তার মনখারাপের সমস্যার, সেটা খুলে বলল সে। ‘তখন শহরটা আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ছিল। আমার মনে ফিরে ফিরে আসছিল ভালবাসার কথা। খুব ইচ্ছে করছিল, সৌভিককে একটা ফোন করি। কিন্তু উপায় নেই। ওর সেদিন নাইট ডিউটি ছিল, কাজের মাঝে ফোন করলে বিরক্তই হবে! চাইলেই তো আর লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপে কথা বলা যায় না। তবে আমার একটা সময়ের পরে আচমকাই আর ঠিক খারাপ লাগছিল না। আমি বুঝতে পারছিলাম ওর অসহায়তার জায়গাগুলো! সৌভিকও ব্যাপারটা জানে। এই নীরবতা, সব সময় অন্যকে উত্যক্ত না-করা আমাদের সম্পর্কটাকে আরও মজবুত করেছে’, জানাচ্ছে সাহানা। সাহানার তাই মনে হয়, প্রেম মানে তো নীরবতাও! ‘একরাশ কথা না কপচেও প্রেম তো অনেকেই করে, তাই না’? পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সে।

তাহলে ভালবাসা মানে যদি নীরবতা হয়, আবার না-ও হয়- তর্কের নিষ্পত্তি হবে কীভাবে? মনোবিদ অনিন্দিতা রায় কিঞ্চিৎ সাহায্য করলেন এ ব্যাপারে জট ছাড়াতে। ‘যে মানুষ এমনিতে বেশি কথা বলে, সে চুপ করে থাকলে বুঝতে হবে কিছু একটা সমস্যা আছে। অন্য দিকে, যাঁরা এমনিতেই কথা কম বলেন, তাঁরা যে প্রেমিক বা প্রেমিকার কাছেও মন উজাড় করে দেবেন- তার তো কোনও মানে নেই। পুরো ব্যাপারটাই নির্ভর করে কার কেমন স্বভাব, তার উপর’! সেই দিক থেকে দেখলে জেন-ওয়াইয়ের বয়সের কারণেই কিছুটা মুখর থাকার কথা। সেটা না-হলেই তাই ধন্ধে পড়ে যায় সবাই। ভাবতে থাকে, নীরবতা মানে ফুরিয়ে আসছে ভালবাসা। সেন্ট থমাস কলেজের ছাত্রী স্বভাব-উচ্ছ্বল অভিষিক্তা বন্দ্যোপাধ্যায় তাই বলছে, ‘প্রেম মানে কেন নীরবতা হবে? সব প্রেম কি নীরব? আমার মনে হয় না। নীরব শব্দটার সঙ্গে কেমন যেন একটা দুঃখভাব জড়িয়ে আছে। নীরব হয়ে প্রেম করা যায় ঠিকই, তবে নীরবতা মানেই প্রেম নয়’। আবার বেঙ্গালুরুর একটি প্রকাশনার কোয়ালিটি অ্যানালিস্ট সম্রাট দে-র কথায়, ‘নীরবতাটা বেশিদিন প্রকট হওয়া মানে প্রেম নেই। একটা বেশ সেম্যান্টিক্সের ব্যাপার’!

প্রস্তর খণ্ডের মাঝে উদ্ভিদের প্রাণ খোঁজার মতো করেই জেন-ওয়াই খুঁজতে থাকে চলতি হাওয়ায় প্রেম ও নীরবতার সম্পর্ক। ফিসফিসে কোলাহলের মাঝে ভালবাসাও যে স্পষ্ট একটা উত্তর দেয় না, অনেকটাই নীরব হয়ে থাকে! সংগ্রহ: আনন্দ বাজার পত্রিকা।

ঢাকা জার্নাল, আগস্ট ২৬, ২০১৩।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.