Leadশিক্ষা-সংস্কৃতিসব সংবাদ

আদালতের নির্দেশেও ৩৬ জনের বেতন হয়নি, দিনমজুর চার কলেজ শিক্ষক

এলাকার পানের বরজে পার্টটাইম শ্রমিক হিসেবে কাজ করে সংসার চালাতেন শামীনুল ইসলাম, রমজান আলী ও জামাল উদ্দিন। আর পানের আড়তে মহুরার (হিসাব লেখালেখির কাজ) হিসেবে কাজ করে দিনে দুইশ টাকা আয় করতেন আলাউদ্দিন। এরা সবাই রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার এমপিওভুক্ত আলীপুর মডেল কলেজের প্রভাষক।  শুধু এই ৩ জনই নয় পার্টটাইম শ্রমিকের কাজ করেন এই কলেজের ৭ শিক্ষক-কর্মচারী। করোনা সংকটের কারণে তাদের এখন কাজ নেই।

কলেজের অধ্যক্ষ সাইফুল ইসলাম জানান, ২০০৪ সালে এমপিওভুক্ত হলেও দীর্ঘ ১৬ বছরের বেশি সময় বেতন বঞ্চিত রয়েছেন আলীপুর মডেল কলেজের ৩৬ জন শিক্ষক-কর্মচারী। কলেজের এসব শিক্ষক-কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা নিজেদের কষ্টের জীবন মেনে নিয়েছিলেন।  তবে আশা ফিরে পান ২০১৭ সালের ৩১ মে হাইকোর্টের রায়ে। আদালত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার নির্দেশ দিলেও পৌনে তিন বছরেও বেতন-ভাতা পাননি ওই ৩৬  শিক্ষক-কর্মচারী। করোনা সংকটে আজ তাদের জীবনে নতুন করে বিপর্যয় নেমে এসেছে। খেয়ে না খেয়ে চলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধিকাংশ শিক্ষক-কর্মচারীদের জীবন।

পার্টটাইম শ্রমিকের কাজ করা আলীপুর মডেল কলেজের আরবি বিষয়ের প্রভাষক সানপুকুর গ্রামের শামীনুল ইসলাম বলেন, ‘২০০৫ সাল থেকে চাকরি করছি বিনা বেতনে। কলেজ সময়ের বাইরে রবিবার ও বুধবার হাটে গিয়ে আড়দারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মসুর, সরিষা গমসহ বিভিন্ন চৈতালি খাদ্যশস্য কিনে আনতে দিলে যে কয় টাকা লাভ হতো তা দিয়েই সংসার চলে না। সংসার চালাতে হাটের দিন ছাড়া অন্যের পানের বরজে কাজ করতে হয়। কিন্তু করোনার কারণে সব বন্ধ, তাই ধার-দেনা করে চলছি। বৃদ্ধ বাবা আর অসুস্থ মা আর দুই সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে পারছি না। আবার শিক্ষক হয়ে কারও কাছে হাত পাততেও পারছি না।’

কলেজের পরিসংখ্যান বিষয়ের প্রভাষক সুর্যভাগ গ্রামের রমজান হোসেন বলেন, ‘পানের বরজে কাজ করা আমাদের কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে সাত থেকে আট জন। এভাবে কষ্টে জীবন চালাতে চালাতে বর্তমানে আমার শারীরিক অবস্থাও খুবই খারাপ। আর এখন তো সব বন্ধ আমরা সবাই কষ্টে আছি।’

কলেজের অর্থনীতি বিষয়ের প্রভাষক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘২০০৩ সাল থেকে কলেজে চাকরি করছি বিনা বেতনে। আমিও পানের বরজে পার্টটাইম কাজ করি। এছাড়া ছোট একটা কাপড়ের দোকানও দিয়েছিলাম। এখন পানের বরজের কাজও বন্ধ কাপড়ের দোকানও বন্ধ না খেয়ে না খেয়ে আমাদের দিন চলছে। আমি ছাড়াও কয়েকজন শিক্ষক পানের বরজে শ্রমিকের কাজ করেন।’

কলেজ শিক্ষক-কর্মচারীদেরর এই দুরবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘২০০৪ সালে এমপিওভুক্ত হলেও অ্যকাডেমিক স্বীকৃতির সংক্রান্ত জটিলতা দেখিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) কলেজের ৩৬ জন শিক্ষক-কর্মকর্তার বেতন বন্ধ রাখে। পরে ২০১১ সালে অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন হলেও এমপিও দেয়নি মাউশি। এ কারণে উচ্চ আদালতে প্রতিকার চাই। ২০১৭ সালের ৩১ মে এমপিওভুক্তির নির্দেশ দেন আদালত। আদালতের নির্দেশের পরও এমপিওভুক্ত হতে পারিনি আমরা ৩৬ জন শিক্ষক-কর্মচারী। আমিসহ এসব শিক্ষক-কর্মচারীরা মানবেতর জীবন যাপন করলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আদালতের নির্দেশের পরও এমপিওভুক্ত না হতে পেরে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে আদালত অবমানার মামলা করি।  তারপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমপিওভুক্ত করতে মাউশিকে নির্দেশনা দেয় গত ১৯ সেপ্টেম্বর। কিন্তু ছয় মাসেও সে আদেশ বাস্তবায়ন হয়নি।

জানা গেছে, আদালত অবমাননার মামলার পর গত বছর ১৯ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয় মাউশির মহাপরিচালককে কলেজটিকে এমপিওভুক্ত করতে নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। এরপর গত ১২ জানুয়ারি উপসচিব কামরুল হাসানের সই করা আদেশে হাইকোর্ট বিভাগের কনটেম্পট পিটিশন ও আপিল বিভাগের ২০১৮ সালের রায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী মাউশির মহাপরিচালককে ৩৬ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গত ১১ মার্চ মাউশি রাজশাহীর আঞ্চলিক উপ-পরিচালককে শোকজ করে মাউশি। কলেজটির ৩৬ শিক্ষককে এমপিওভুক্ত কেনও করা হয়নি তা জানাতে ৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর আঞ্চলিক উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ড. শরমিন ফেরদৌস বলেন, ‘মাউশির আদেশ পাওয়ার পর প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।  শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত হয়নি কেনও জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষকরা অনলাইনে আবেদন করেননি। ‘

অনলাইনে আবেদন করার বিষয়ে অধ্যক্ষ সাইফুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের কারণে পারিনি। তিনি অনলাইন আবেদনের জন্য ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেননি। পরে মাউশি থেকে আবেদন করে ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড নিয়েছি। কিন্তু অনলাইন আবেদন করতে গেলে শূন্য পদ নেই দেখাচ্ছে। এ বিষয়ের সমাধান চাইলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার কোনও সহযোগিতা করেননি।’

এ বিষয়ে জানতে জাইলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নাজমুল হক বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের আদেশ দেওয়ার পরই আমি তাদের অনলাইন আবেদনের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়েছি। রেগুলার কমিটি নেই তাই তারা আবেদন করেননি। তারা অনলাইনে আবেদনের কখনও চেষ্টাই করেনি। তবে এখন আবেদন করেছে কিনা আমি জানি না। মাসখানেক থেকে কলেজের এমপিওর বিষয়টি দেখছেন আঞ্চলিক পরিচালক। তাছাড়া এখন উপজেলা নির্বাহী অফিসার সভাপতি সেখানে গিয়ে তারা ব্যবস্থা করবেন।’

অধ্যক্ষ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে আমরা আবেদন জানিয়েছি। তিনি ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন।’