আজ পাঁচ মিনিট স্তব্ধ থাকবে জেলা শহর
আজ ৮ ডিসেম্বর, নেত্রকোনা ট্র্যাজেডি দিবস। সকাল ১০টা ৪০ মিনিট বাজলেই সবাই কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে আসবে। ১০টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত স্তব্ধ থাকবে নেত্রকোনা। এই পাঁচ মিনিটে শহরের রাস্তায় চলবে না যানবাহন; হাঁটবে না পথচারীরা। ৮ ডিসেম্বরের বোমা হামলায় নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা জানাতেই এ কর্মসূচি।
২০০৫ সালে আজকের দিনে সকালবেলায় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী নেত্রকোনা জেলা সংসদ কার্যালয়ের সামনে চলছিল নেত্রকোনা হানাদারমুক্ত দিবস (৯ ডিসেম্বর) উপলক্ষে কর্মসূচির প্রস্তুতি। এ সময় সেখানে আত্মঘাতী হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন জেএমবি। এতে প্রাণ হারান নেত্রকোনা উদীচীর সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক খাজা হায়দার হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক সুদীপ্তা পাল শেলি, মোটরসাইকেল মেকানিক যাদব দাস, পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী রানী আক্তার, মাছবিক্রেতা আফতাব উদ্দিন, শ্রমিক রইছ মিয়া, ভিক্ষুক জয়নাল ও আত্মঘাতী হামলাকারী আল বাকি মো. কাফি। আহত হন অর্ধশতাধিক ব্যক্তি।
এ ঘটনা নিয়ে পরে চলে নানা নাটকীয়তা। নিহত যাদব দাসকে বানানো হয় ‘হিন্দু জঙ্গি’। এমনকি তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর বলেছিলেন, ‘এটি একটি নিউ ডাইমেনশন। এটি হিন্দু জঙ্গি। উই আর লুকিং ফর শত্রুজ।’ বাবরের এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে চলে যাদবের পরিবারসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও সংস্কৃতিকর্মীদের ওপর নানা হয়রানি। তারপর গণমাধ্যমকর্মী ও সংস্কৃতিকর্মীরা প্রমাণ করেন, যাদব জঙ্গি নন। একপর্যায়ে বাবর তাঁর ভুল স্বীকার করেন।
এদিকে ঘটনার ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও স্বজনহারা পরিবারগুলো এখনো অসহায়ভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এসব পরিবারের জন্য এখনো একবিন্দু সরকারি সাহায্যও মেলেনি।
নিহত খাজা হায়দার হোসেনের স্ত্রী শাহনাজ বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার পরিবারে স্বামীই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। কৃষিজমি না থাকায় সন্তানদের লেখাপড়া ও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আজ পর্যন্ত সরকার বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি।’
হামলার ঘটনার পরদিন পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা করে। বোমা হামলার মামলায় জঙ্গিনেতা সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাইয়ের স্ত্রী ফাহিমা বেগম ফারজানাসহ তিনজন ও বিস্ফোরক মামলায় ফাহিমাসহ চারজনকে আসামি করা হয়। ফাহিমা হামলায় সম্পৃক্ততার কথা স্বীকারও করেছিলেন। তারপরও ২০০৮ সালে নেত্রকোনার আদালত তাঁকেসহ দুজনকে বোমা হামলার মামলায় খালাস দেন। অন্য দুজনের ফাঁসির রায় হয়। আরেক মামলায় ফাহিমাসহ তিনজনের বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড হয়। খালাস দেওয়া হয় অপরজনকে। বর্তমানে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা দুটি বিচারাধীন।
দিনটি উপলক্ষে নেত্রকোনার সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আয়োজকদের পক্ষে উদীচী নেত্রকোনা জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক নীলম বিশ্বাস জানান, কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আজ সকাল নয়টায় কালো পতাকা উত্তোলন ও কালো ব্যাজ ধারণ, সাড়ে নয়টায় কার্যালয়ের উদীচী স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন ও পুষ্পস্তবক অর্পণ, ১০টা ৪০ মিনিট থেকে ১০টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত ‘স্তব্ধ নেত্রকোনা’, ১১টায় শহরের ছোটবাজার এলাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে প্রতিবাদ মিছিল, ১২টায় শহীদদের কবর জিয়ারত, শ্মশানের স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও শহীদদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ। এ ছাড়া বিকেল চারটায় উদীচী স্মৃতিস্তম্ভ প্রাঙ্গণে সন্ত্রাস, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান আলোচক হিসেবে থাকবেন কেন্দ্রীয় উদীচীর সাবেক সভাপতি প্রাবন্ধিক যতীন সরকার। একই স্থানে রাত আটটার দিকে সেন্টু রায় নির্মিত ‘পরিচয় কোনো আছে নাকি’ তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হবে।
হামলার প্রত্যক্ষদর্শী কেন্দ্রীয় উদীচীর কার্যকরী কমিটির সদস্য মো. মোস্তাফিজুর রহমান খান বলেন, ‘সংস্কৃতিকর্মীরা সত্য-সুন্দর অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ বাংলাদেশের কথা বলে। সে কারণেই নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন স্থানে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর হামলা। আমরা মনে করি, এই জঙ্গিগোষ্ঠী, ধর্মান্ধ মৌলবাদী ও যুদ্ধাপরাধীরা একই সুতোয় গাঁথা। তাই সবাই মিলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে তাদের প্রতিহত করতে হবে।’