আজ পদ্মাপাড়ে স্বপ্নের উৎসব
পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল যে জায়গাটায়, সেই স্থান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে মাওয়ায় সাত নম্বর পিলারের কাছে যাচ্ছেন আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যাঁর দৃঢ়তায় পদ্মায় রূপ পাচ্ছে দেশের বৃহত্তম সেতু। এখানে সেতুর মূল পাইলিংকাজ পরিদর্শন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে জাজিরায় নদীশাসন কাজের উদ্বোধন শেষে স্পিডবোটে করে পাইলিং দেখে দুপুর ১২টায় মাওয়া চৌরাস্তার পাশে পদ্মা সেতুর ভিত্তিফলক উন্মোচন করে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর মূল কাজের উদ্বোধন করবেন তিনি।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, উদ্বোধনের আগেই মূল সেতুর কাজ ১৩ শতাংশ এগিয়েছে। নদীশাসনের কাজ এগিয়েছে ১৪ শতাংশ। মাওয়া সংযোগ সড়ক এগিয়েছে ৬৩ শতাংশ; জাজিরা সংযোগ সড়ক ৫৫ শতাংশ; সার্ভিস এরিয়া-১ ১০০ শতাংশ এবং সার্ভিস এরিয়া-২-এর কাজ ৬৮ শতাংশ এগিয়েছে।
বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকার মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার কোনো সহায়তা না নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবলের কারণেই নিজস্ব অর্থায়নে শুরু হওয়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজে এখন উড়ন্ত গতি। ২০১৮ সালের মধ্যে ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তাতে করে ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হবে। প্রকল্পে ব্যয় হবে ২৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। দোতলা এই সেতুর নিচতলায় ট্রেন চলাচল করবে। তার জন্য আলাদা আরো একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। তাতে ব্যয় হবে ৩২ হাজার কোটি টাকা।
২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল আলো ঝলমলে দুপুরে ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরের মাওয়ায় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর মাধ্যমেই এক যুগ আগে বোনা পদ্মা সেতু প্রকল্পের বীজ যেন অঙ্কুরিত হতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ ছন্দপতন হয়। বিশ্বব্যাংক ওই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পরে অর্থায়ন স্থগিত করে। বিশ্বব্যাংকের মনোনীত ঠিকাদারদের কাজ না দেওয়ায় প্রায় দুই বছর আটকে থাকে প্রকল্পের কাজ। তবে বিশ্বব্যাংককে বাদ দিয়ে সরকার নিজস্ব অর্থায়নের ওপর ভর করে দেশের সবচেয়ে বড় এই সেতু প্রকল্পের কাজ শুরু করে দেয়।
নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পের কাজ বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে দেখে প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘মন্ত্রী মহোদয় দিন-রাত পরিশ্রম করছেন। আমরা বড় এই কাজ নির্ধারিত সময়ে করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নিজেদের অর্থে এই সেতু নির্মাণ একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।’
মাওয়ার শিমুলিয়া থেকে পদ্মা নদী পাড়ি দিতে হচ্ছে ফেরি, স্পিডবোট, লঞ্চ ও নৌকায়। তাতে করে নদী পার হতেই কমপক্ষে দেড়-দুই ঘণ্টা লাগছে; তা-ও যদি ফেরি পাওয়া যায়। শিমুলিয়া ঘাট থেকে ফেরি দিয়ে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ীর দূরত্ব আট কিলোমিটার। এই দূরত্ব পার হতেই লাগছে কমপক্ষে দেড় ঘণ্টা। অথচ সেতু চালু হলে সড়কপথে চলাচলে গতি বাড়বে কমপক্ষে ১০ গুণ।
মূল পদ্মা সেতুর পাইলিং ও নদীশাসনের উদ্বোধন হবে বলে আজ দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলাবাসী উচ্ছ্বসিত। শরীয়তপুরের নাওডোবার গৃহবধূ হাসিনা বেগম গতকাল বিকেলে প্রকল্পের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন, ‘ওইখানে আমাগো বাড়ি ছিল। সেতুর লাইগা দিয়া দিছি। শেখের বেডি টাহা-পয়সা দিয়া দিছে। অহন হেয় আইবো, উদ্বোধন করব—খুশি লাগতাছে।’
পদ্মা নদীর জাজিরা থেকে মাওয়া পর্যন্ত একের পর এক ৪২টি নৌকা রাখা হবে। এসব নৌকার প্রতিটিতে থাকবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি। লাল-সবুজের কাপড়ে শোভিত থাকবে নৌকাগুলো।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে জাজিরায় যাবেন। সেখানে নদীশাসন কাজের উদ্বোধন করবেন, সুধী সমাবেশে অংশ নেবেন। এরপর জাজিরা থেকে স্পিডবোটে করে এসব সুসজ্জিত নৌকা দেখে দেখে যাবেন মাওয়ায়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে থাকবে ১৮টি স্পিডবোট। দুপুর ১২টায় প্রধানমন্ত্রী মাওয়ায় ভিত্তিফলক উন্মোচন করবেন। তার আগে সাত নম্বর পিলারের কাছে পাইলিংকাজ দেখবেন।
বাংলাদেশ সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তের পর ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর জাজিরা সংযোগ সড়কের ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় এএলএম এইচসিএম (জেভি)কে। ২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি মাওয়া সংযোগ সড়ক নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য একইভাবে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। উভয় দিকে সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়ার কাজ শুরু হয়। গত বছরের ১৭ জুন মূল সেতুর ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনকে। নদীশাসনের জন্য চীনের সিনো হাইড্রোর সঙ্গে চুক্তি হয় গত বছরের ১০ নভেম্বর। চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে চীনা দুই প্রতিষ্ঠান মালামাল এনে কাজ শুরু করে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের ২০ জন প্রকৌশলী প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে দিন-রাত ছুটছেন। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন অনুষ্ঠান ঘিরে তাঁদের কাজের গতিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। সেতু বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী (সড়ক) সৈয়দ রজব আলীর কাছে জানতে চাইলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, প্রকল্পের সব গাড়ি প্রকল্প এলাকায় ছুটছে। প্রস্তুতিকাজ শেষ হয়েছে।
মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ পেয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজার (নির্মাণ) এম ফজলে মোনায়েম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮০০ শ্রমিক কাজ করছে। জাজিরা অংশে আছে ৭০০ শ্রমিক।’
প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে মাওয়ায় আনন্দের বন্যা বইছে। গতকালও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বাদ্যবাজনা নিয়ে নেমে পড়ে বিভিন্ন এলাকায়। মাওয়া চৌরাস্তা থেকে কিছুটা দক্ষিণে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের পূর্ব প্রান্তে উদ্বোধনী ভিত্তিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। পাশে নির্মাণ করা হয়েছে সুধী সমাবেশের মঞ্চ। দুপুর ১২টায় ভিত্তিফলক উন্মোচনের পর প্রধানমন্ত্রী এখানে এক সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেবেন। মেদিনী মণ্ডল খান বাড়ির কাছে মহাসড়কের পশ্চিম প্রান্তে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল মঞ্চ। এখানে প্রধানমন্ত্রী বিকেল ৩টায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসমাবেশে বক্তব্য দেবেন। দুপুরে তিনি শ্রীনগরের দোগাছি সার্ভিস এরিয়ায় তাঁর জন্য নির্মিত ভিভিআইপি কটেজে মধ্যাহ্নভোজ সারবেন।
লৌহজং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল রশিদ সিকদার জানান, প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশকে সফল করতে আড়াই লাখ লোক সমাগমের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। কয়েক দিন ধরে স্থানীয় এমপি সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি এ কাজের তদারকি করছেন।
সেতুর ওপর দিয়ে গাড়িতে চড়ে রাজধানীতে যাওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে বলে জাজিরাবাসীও উচ্ছ্বসিত। পূর্ব নাওডোবা গ্রামের মোখলেছ মাদবর বলেন, ‘আমাদের জমিজমা গেছে তাতে কোনো দুঃখ নেই, পদ্মা সেতু নির্মাণ হচ্ছে তাই। আমরা এখন অপেক্ষায় আছি কবে গাড়িতে চড়ে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকায় যেতে পারব।’