আকতার জাহান যা বলেছিলেন আমাকে ।। শাওলী মাহবুব
শাওলী মাহবুব ।। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষক আকতার জাহানের মৃত্যু অনেক প্রশ্নকেই সামনে আনে। এই লেখা আকতার জাহানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সাবেক সহকর্মী হিসেবে লিখছি।
সতের বছর পরিচয়কালে ব্যক্তিগত অনেক কষ্টের কথা আমার সাথে শেয়ার করতেন তিনি। শোকবিধ্বস্ত এই নিবন্ধটি হয়তো লেখাও হতো না, যদি না তার সাবেক স্বামী চিরাচরিত পদ্ধতিতে সামাজিক মাধ্যমে আকতার জাহানের চরিত্রহননের কাজটি না করতেন। এই লেখা আকতার জাহানের জন্য শুধুমাত্র হাহাকার করে আবেগপ্রসূত লেখা নয়; তার ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পুরো সমাজকেই দেখতে পাচ্ছি। অতীতে বিভিন্ন সময় আকতার জাহানের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্যই আজকের লেখার উপাত্ত।
আকতার জাহানের মৃত্যু তাঁর জীবনের অতীতকেই সামনে নিয়ে এসেছে। আকতার জাহানের ভাষ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী শিক্ষক হিসেবে তিনি উপার্জন করেছেন ঠিকই, কিন্তু সেই উপার্জনের উপর তার ব্যক্তিগত অধিকার অনেকাংশেই ছিলনা, তাঁর (প্রাক্তন) স্বামীর অনুমতি ছাড়া তিনি তা খরচ করতে পারতেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি তার প্রাক্তন স্বামীর অনুমতি ছাড়া একাডেমিক কোন কাজে, তা ভিসির অফিসের মিটিং হোক বা একাডেমিক কমিটির মিটিংই হোক, অংশ নিতে পারতেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষক হিসেবে তার স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার বাসার কাজের সাহায্যকারী রাখতে পারতেন না। তাকেই সমস্ত কাজ, যেমন রান্না করা, বড় হাঁড়িতে পানি ফুটানোসহ সবই করতে হতো। এই বড় হাঁড়ি টানতে টানতে আকতার জাহানের পিঠে তীব্র ব্যথা তৈরি হয়েছিল; ভারত থেকে চিকিৎসা করে এসেও মুক্তি মেলেনি সেই ব্যথার। ঘনিষ্ঠজন ছাড়া কোথাও তিনি লোকলজ্জায় একথা জানাননি।
এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী শিক্ষক তার বাবা-মায়ের পরিবার থেকেও অনুমতি পাননি তার প্রেম করে বিয়ে করা স্বামীকে তালাক দেয়ার।কেননা তাতে পরিবারের মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে। শেষমেষ আকতার জাহানের ভাষ্যমতে, যখন উদ্যত ছুরি নিয়ে তাকে আক্রমণ করা হয়েছে, তখন জান বাঁচানোর প্রয়োজনে এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়েছেন এবং জুবেরী হাউসে এসে উঠেছেন। জীবনের মায়া যে তার ছিল ঘনিষ্ঠজনরা তা জানেন। তাহলে তিনি কেন মৃত্যুবরণ করলেন?
আকতার জাহানের দাফন হবার পূর্বেই তার প্রাক্তন স্বামী ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, তার চরিত্র খারাপ ছিল তাই আকতার জাহানের সাথে তার সম্পর্ক ভেঙেছে। তাই যদি হয়, তবে নিশ্চিতভাবেই ডিভোর্সের চার বছরের মধ্যে প্রাক্তন স্বামীর মতো তারও বিবাহিত থাকার কথা। এবার তাহলে বলা যাক, আমরা কী শুনেছি আকতার জাহানের কাছ থেকে।
বিভিন্ন নারীর সঙ্গে তার প্রাক্তন স্বামী সম্পর্ক গড়ে তুলতেন- এই ইঙ্গিত দিয়ে আকতার জাহান তার গভীর মনোকষ্টের কথা বলেছিলেন। অনেকদিন ধরে চেপে রাখার পর, এই লজ্জাজনক তথ্য সম্প্রতি তিনি জানিয়েছিলেন। শ্বশুরবাড়ির দিক থেকেও ছিল নানান উপদ্রব। তার প্রাক্তন স্বামীর মা ফর্সা ছিলেন। ‘কালো বৌ’ হবার কারণে অনেক কথা শুনতে হয়েছে আকতার জাহানকে। প্রশ্ন জাগে মনে, বাঙালি সমাজ কতদূর এগোলো?
আকতার জাহানের সুইসাইড নোট-এ দেখা যায়, ছেলেকে নিয়ে তার গভীর উদ্বেগ ও উদ্বিগ্নতা ছিল। তাঁর কাছ থেকেই শুনেছি, তার ছেলে সোয়াদকে তিনি ফোন করতে পারতেন না। লুকিয়ে তাকে মায়ের সাথে ফোনে কথা বলতে হতো। সোয়াদকে তার প্রাক্তন স্বামী মায়ের কাছে আসতে দিতে চাইতেন না জুবেরী হাউসে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ পশ্চিম পাড়ার আবাসিক এলাকা থেকে জুবেরী হাউসে আকতার জাহানের ৩০৩ নম্বর রুম এর দূরত্ব পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। ছেলের গলায় ছুরি ধরার যে প্রসঙ্গটি আকতার জাহান সুইসাইড নোটে লিখেছেন, সেই ঘটনাটি কয়েক মাস আগে ঘটেছিল মায়ের সঙ্গে গোপনে দেখা করার কারণেই।
এ প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত কথাও চলে আসে। আকতার জাহানকে যারা চিনতেন তারা জানেন, তিনি ঢাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আলোকিত মানুষ, তাদের যৌতুক নেবার কথা নয়। কিন্তু তানভীর আহমদ-এর বাড়ির রেফ্রিজারেটর থেকে শুরু করে অনেক আসবাব আকতার জাহানের মায়ের বাড়ি থেকে আনা। ডিভোর্সের পর আসবাবপত্র ফেরত চাইলে প্রাক্তন স্বামী কয়েক জোড়া ছেঁড়া জুতা আর পুরনো কাপড় পাঠিয়েছেন।
আকতার জাহান এই তথ্যটি ঘনিষ্ঠ একজনের সঙ্গে শেয়ার করে বিষাদমাখা কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না।’ আকতার জাহানের কাছ থেকে শুনেছি, তার ঘনিষ্ঠ একজন বান্ধবী যিনি জার্মানিতে থাকতেন, তার কাছ থেকে সোয়াদের জন্য উপহার হিসেবে পাওয়া দামী ঘড়ি ছেলেকে না দিয়ে তার প্রাক্তন স্বামী নিজে পরে ঘুরতেন। ডিভোর্সের পর ছেলের জন্য মায়ের দেয়া টি-শার্টও দেখা যেত তার প্রাক্তন স্বামীর গায়ে।
স্বভাবে সৌখিন ছিলেন আকতার জাহান। ডিভোর্সের পর এই সৌখিন মানুষটি মেলামাইনের প্লেটে ভাত খেতেন। জুবেরী হাউসে তার রুমে একটা সিঙ্গেল খাট, পড়ার টেবিল, একটা স্যুটকেস, পেছনের বারান্দায় একটা মেলামাইনের প্লেট, দুটো হাঁড়ি, পানির বোতল নিয়ে তিনি দিন যাপন করছিলেন। বোঝাই যায় কোনোরকমে ছন্নছাড়া দিন কাটাচ্ছিলেন তিনি। অথচ ঘনিষ্ঠজনেরা জানেন, ছবির মতো করে প্রাক্তন স্বামীর সংসার সাজিয়েছিলেন তিনি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মেধার সমীচীন ব্যবহার কি আমরা করতে পেরেছি?
সোয়াদকে নিজের কাছে কিংবা ঢাকায় আনা নিয়ে তাকে নিরন্তর চেষ্টা চালাতে হয়েছে। আকতার জাহানের সুইসাইড নোট থেকে দেখা যায় ছেলের জীবন নিয়ে সংশয়ে ছিলেন তিনি। ঘনিষ্ঠজনেরা এবং তার সহকর্মীরাও এখবর জানতেন। নিজের নতুন বিয়ের পর এক পর্যায়ে তার প্রাক্তন স্বামী ছেলেকে আকতার জাহানের হাতে তুলে দিয়েছেন। ততদিনে সোয়াদ তার পরীক্ষায় কিছু বিষয়ে ফেল করেছে। নিরন্তর মনোকষ্টের শিকার সোয়াদ তার পড়াশোনাও ঠিকমতো চালিয়ে যেতে পারেনি। তার প্রাক্তন স্বামীর যত্নের প্রমাণ সোয়াদের প্রগ্রেস রিপোর্টে রয়েছে।
পুরো বিবাহিত জীবনে আকতার জাহানকে তার স্বামী কোনো উপহার দিয়েছেন বলে ঘনিষ্ঠজনেরা জানেন না। এ নিয়ে আকতার জাহানের বেদনাবোধ ছিল। দীর্ঘকালের এসব বেদনাবোধের সাথে যুক্ত হয়েছে তার ছেলে সোয়াদের নিরাপত্তাবোধ। মা হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে তিনি যে অনন্য ছিলেন ঘনিষ্ঠজনেরা তা নিশ্চিতভাবেই জানেন। কারণ তার আতিথ্য অনেকেই গ্রহণ করেছেন।
অন্তত আকতার জাহানের কাছ থেকে আমরা যে ভাষ্য শুনেছি, তা যদি সত্যি হয়, তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, পুরো সমাজই তাকে আত্মহননে সহায়তা করেছে। এই আত্মহত্যার জন্য ভদ্রতার কারণেই আকতার জাহান কাউকে দায়ী করে যাননি। ছেলের নিরাপত্তাকেই কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন। আমরা কী ভাবতে পারি আমরা কোন সমাজে বাস করি যেখানে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকও বাধ্য হন আত্মহননে?
আকতার জাহানের ঘনিষ্ঠজনেরা, একই বিভাগের সহকর্মীরা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এতসব জেনেও চুপ ছিলেন। কেন ছিলেন? কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সহায়তা সেন্টার নেই, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এতো কিছু জেনেও কেন চুপ ছিল? কারণ আকতার জাহান নারী। নারীর গায়ে চরিত্রহননের প্রলেপ দেয়া যায় সহজেই।
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আকতার জাহান-এর যদি এতো দুরবস্থা হয়, তাহলে অশিক্ষিত আকতার জাহানদের অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়। বিয়েটাকে বাংলাদেশের মেয়েরা সারা জীবনের মনে করে, সংসার সাজায়। কিন্তু বাস্তবতাটা কী? আকতার জাহানের কেস তা বলে না, এমন হাজার কেস তা বলে না। আমাদের করণীয় তবে কী? আত্মহত্যার পথে ঠেলে না দিয়ে আইনী ব্যবস্থা নারীবান্ধব করা কি জরুরি নয়?
বাংলাদেশ এখন আর আদিম সমাজ নয়। প্রতিষ্ঠানগত উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। নতুবা হাজারো আকতার জাহানকে আমরা হারিয়ে ফেলবো, সোয়াদরা হারাবে তাদের ভালোবাসার মাকে। নিরন্তর যুদ্ধ করতে করতে, কারও সহায়তা না পেয়ে আকতার জাহান হতক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
শাওলী মাহবুব, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা