শীর্ষ সংবাদ

সোহাগির প্রেম

jeeban_jouban_19_hঢাকা জার্না: পুরোপুরি নিজের শর্তে বাঁচার সত্যি গল্পের প্যান্ডোরার বাক্স এই বিভাগ। সামনে অচেনা কয়েকজন, আর তাঁদের খেয়াল-খুশিতে ভরানো অনাবিল যৌবন-যাপনের কাব্য| সম্পর্কের চেনা ফ্রেমে সে-সব ছবি আঁটে না, কিন্তু মেলে এক বৃহত্তর জীবনের ইঙ্গিত| কিভাবে, কখন ‘এলিয়েন’ হয়ে গেলেন তাঁরা? নাকি এই বাঁচাটাই স্বাভাবিক, যেটা সমাজের চোখ-রাঙানিতে আমরা স্বীকার করতে পারিনি? পড়ুন সোহাগীর প্রেম। লিখেছেন
স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়, কোলকাতা।

‘শিক্ষা, রুচি, চাকরি, সহবত এসব দিয়েও গ্রামের মেয়ে, কাজের লোকের মেয়ের শিক্ষিত সমাজে ঠাঁই হল না, ভালবাসা দূর অস্ত’। কথা বলতে চাই, বলতেই সোহাগি প্রথমেই চারপাশ থেকে পাওয়া নানান হতাশার কথা দিয়ে ওর জীবনের বাস্তবকে আমার সামনে নিয়ে এল।

‘আমার মা যে বাড়িতে সারাদিনের কাজ করতেন সেখানে আমিও ওই বাড়ির মেয়ের সঙ্গেই মানুষ হয়েছি। আমি আর মুনিয়াদি, মানে ওই বাড়ির একমাত্র মেয়ে, আমরা একই বয়সের ছিলাম। ওর মতোই স্কুলে যেতাম আমি। মুনিয়াদির মায়ের জন্যেই আমার পড়াশুনা, রুচি, রান্না শেখা। উনি না থাকলে আজ হয়তো আমার দিদির মতোই মাতাল বরের পিটুনি খেয়ে বাড়ি বাড়ি আমায় বাসন মাজতে হত। স্কুল, কলেজ পেরিয়ে মন্টেসারি ট্রেনিং নিয়ে এখন একটা এনজিও-তে চাকরি করি আমি। বস্তির ছেলেমেয়েদের পড়াই। ওই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যেও আমি আমার শৈশবকে দেখতে পাই। মনে হয়, আমিও তো ঠিক এরকম একটা জায়গা থেকেই উঠে এসেছিলাম’!

‘আমার কাজটা সত্যি আমার জীবনে অনেক খুশির মুহূর্তের জন্ম দিয়েছে। গ্রামের কুঁড়ে ঘরে টিনের ছাদ বসেছে, মাকে সোনার দুল দিতে পেরেছি, হাড় ভাঙা শরীরে বাবার সাইকেল রিক্সা চালানো বন্ধ করেছি। তবে বছরে দু’-একবারই যাই ওখানে। আমার বাড়ি হলে কী হবে, শহুরে জীবনের আদব কায়দায় বেড়ে ওঠা আমি শিকড়কে মনে রাখলেও শিকড়ে ফিরতে তো চাইনি। আমার বাড়িতে যদিও এখন আমার খুব কদর। আগে এক বোনের পরে, কালো রঙের বাজে দেখতে মেয়ে নিয়ে বাবা, মায়ের হেলাফেলা ছাড়া আর কিছু জোটেনি আমার। মা সেই কারণেই শহর ছাড়ার পর আমায় কলকাতায় রেখে আসতে পেরে বেঁচেছিল। কিন্তু এখন এই রোজগেরে কালো মেয়েই যে তাদের একমাত্র সম্বল, দুটো ছেলে থাকার পরেও তারা সেটা বুঝতে পেরেছে। তবে আমার বিয়ে নিয়ে তারা বড়ই চিন্তিত’।

‘বিয়ে করনি কেন তুমি’?- জানতে চাই সোহাগির কাছে। সোহাগির চোখ চিকচিক করে। রবীন্দ্রনাথ চলে আসে আমার মনে-‘স্ফটিক সে নির্বিকার আকাশের মতো/ সেথা আসে শশী রবি, /যায় চলে, তার ছবি/ কোথা হয় গত’। ‘নিজে থেকে প্রেমে পড়ার সাহস বা ক্ষমতা আমার ছিল না। সমাজের একেবারে নিচের স্তর থেকে শহুরে উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে কাজের লোকের মেয়ে হিসেবে যখন কোনও মেয়ের ওপর শিক্ষা, ভাল করে বাঁচার, নিজের উপার্জনে পৃথিবী দেখার স্বপ্ন ছড়ায় তখন সেটা স্বপ্ন হয়েই থেকে যায়। বাস্তবে তা হয় না। মুনিয়াদির সঙ্গে মানুষ হওয়ায় মুনিয়াদির কিছুটা প্রভাব, ওই বাড়ির ধাঁচ-ধরন আমার জীবন তৈরি করেছিল এটা ঠিক-ই, কিন্তু আমি তো কোনওদিন মুনিয়াদি হতে পারব না, বা ওর বন্ধুরা আমার বন্ধু হবে না। আমি স্কুলে পড়েছি, কিন্তু সাধারণ স্কুল। ইংরেজি খুব ভাল বলতে পারি না আমি। মুনিয়াদিদের সঙ্গে বেড়াতে যাই, রেস্তোরাঁয় এক সঙ্গেই খাই, এক হোটেলেই থাকি, খাদির জামাই পড়ি, কিন্তু আজও মুনিয়াদির জন্যে গীতবিতান থেকে গান লিখে দিতে হয় আমাকেই, ওর আলমারি গুছিয়ে দিতে হয় আমাকেই। আসলে কাজের লোকের মেয়ে এই তকমাটা পুরো মুছে বোধহয় যায় না। ওটা কেবল বাংলা গল্প, আর বাংলা চ্যানেলের সিরিয়ালেই হয়। আসলে মুনিয়াদি, ওর মা, বাবা, তাদেরও দোষ দিতে পারি না। অনেক করেছে ওরা। ওদের জোরেই তো কান্না-হাসি নিয়ে বেঁচে আছি আমি। ওটা এখন আমারও বাড়ি’।

‘তবে বিয়ে হবে না আমার। চাকচিক্য নেই আমার শরীরে। ওটা তো আমার পরিবারের ধারা। আমারও নিজের প্রতি কোনও যত্ন নেই। মুনিয়াদি ফেস প্যাক থেকে ক্রিম কত কী দিয়েই তো চেষ্টা করেছিল। আমার কিছুই ভাল লাগে না। নিজের জন্যে কিছুই করতে ইচ্ছে হয় না। মুনিয়াদির ছোট্ট মেয়ে আমার সঙ্গে থাকে, ওকে নিয়ে আর স্কুল গিয়েই আমি বেশ থাকতে পারি। আমার বিয়ে হবে না। কারণ ড্রাইভার, মিস্তিরি এদের সঙ্গে আমি কেমন করে থাকব? আমার তো প্রতি সকালের ঘুম ভেঙেছে রবীন্দ্রনাথের গান শুনে। আর শিক্ষিত সমাজের কোনও পুরুষ কাজের লোকের, গ্রামের কালো মেয়েকে বিয়ে করবে না’।

‘কিন্তু আমার শরীর, মন এদের কেমন করে বোঝাই? মুনিয়াদির সঙ্গে ওর বরের বিছানা-আদর তো আমি সুযোগ পেলেই লুকিয়ে দেখি আর নিজে কষ্ট পাই। অনেক সময় রাতে ঘুম পেলেও রাত জেগে থাকি, ওরা কী করছে সেটা দেখার জন্যে। সকালে বিছানা তুলতে গিয়ে দেখি কেমন যেন সব এলোমেলো! অথচ আমার বিছানা কেবলই শুকনো, বাসি। মুনিয়াদি বকাবকি করে বলে, নতুন চাদর নিয়মিত পাল্টাস না কেন? ওকে কী করে বোঝাই আমার চিরকালীন রিক্ততার কাহিনি! একসঙ্গে এতগুলো বছর কাটিয়েও তো ওর পূর্ণতার মধ্যে দিয়ে আমি কেবল আমার রিক্ততাকেই দেখি, কাজের লোকের মেয়ে বলেই কি আমার এই হাল?’ সোহাগি প্রশ্ন করে আমায়।

সোহাগির প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। এটা লিখতেও খুব মনখারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে, আসলে কিছুই বোধহয় বদলায় না। সবটাই ওপর ওপর বদলায়, নয়তো সোহাগির মতো শিক্ষিত, রুচিশীল মেয়ের সোহাগ হয় না? আমার অবান্তর স্মৃতির ভিতরে সোহাগির অশ্রু ঝলমলে মুখ আজীবন আমায় প্রশ্ন করে যাবে- সোহাগির সোহাগ হয় না কেন? সৌজন্যে ‍আনন্দবাজার পত্রিকা।

ঢাকা জার্নাল, আগস্ট ২৬, ২০১৩।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.