দেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রশংসিত হচ্ছেন শেখ হাসিনা
টানা ৪২ বছর ধরে দেশের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী দলটির শীর্ষ পদে অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব প্রদানের বিবেচনায় বাংলাদেশ তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। বড় রাজনৈতিক দলে দীর্ঘদিন নেতৃত্বে থাকার ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে শেখ হাসিনা ছাড়া কোনও রাজনীতিক বর্তমানে নেই। তার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ চারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে, যা তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টানা তিন মেয়াদসহ রেকর্ড চার মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন বঙ্গবন্ধুর এই জ্যেষ্ঠ কন্যা। দীর্ঘ সময় বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালনের রেকর্ড তার ঝুলিতে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেশে এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার কোনও বিকল্প নেই। দেশের নেতৃত্ব হোক কী দলের, শেখ হাসিনা এখন অবিকল্প হয়ে উঠেছেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রশংসিত হচ্ছেন বিশ্বদরবারেও।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হওয়ার পর নানামুখী ষড়যন্ত্রে, কোন্দলে বিভাজিত হয়ে খণ্ডিত হওয়ার মুখোমুখিতে পড়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। দলটির এই ক্রান্তিকালে বিদেশে অবস্থান করেও ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন দলটির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ওই বছরের ১৭ মে তিনি দেশে ফিরে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের দায়িত্ব নেন। এরপর থেকে বর্তমান পর্যন্ত টানা ৪২ বছর ধরে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ সময় তিনি ‘ব্রাকেট বন্দি’ দলের ‘ব্রাকেট’ তুলে দিয়ে আওয়ামী লীগকে দেশের শক্তিশালী রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছেন। প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নিজেকে দলের জন্য বিকল্পহীন জায়গায় দাঁড় করিয়েছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অতীতের যেকোনও সময়ের তুলনায় শক্তিশালী-সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশও আজ বিশ্বের উন্নয়নের রোল মডেল।
দিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেওয়ার দিক থেকে পিতা শেখ মুজিবকে আগেই ছাড়িয়ে গেছেন কন্যা শেখ হাসিনা। যুগ্ম সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সদস্যসহ সব পদ মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু ২৬ বছর দলের রাজনীতিতে ছিলেন। অপরদিকে সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা ৪২ বছর ধরেই দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান শেখ হাসিনা ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। কলেজে পড়ার সময় তিনি ছাত্রলীগের মনোনয়নে কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সদস্য এবং রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রলীগের নেত্রী হিসেবে তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলন এবং ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
সরকার পরিচালনায় শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য রাষ্ট্রপ্রধানদের থেকে এগিয়ে রয়েছেন। বর্তমান মেয়াদসহ তিন টার্মে প্রায় ১৫ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সব মিলিয়ে তার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বকাল ২০ বছর ছুঁই ছুঁই। তিনি ১৯৮৬ সালে দুই বছর এবং ১৯৯১ সাল থেকে পাঁচ বছর এবং ২০০১ সাল থেকে পাঁচ বছর মোট ১২ বছর সংসদে বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশের তিনটি জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন শেখ হাসিনা। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয় আওয়ামী লীগ। প্রথমবারের মতো বিরোধীদলীয় নেতা হন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর পর গণঅভ্যুত্থানের মুখে এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনেও দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে বিরোধীদলীয় নেতা হন তিনি। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদেও বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ হিসাবে শেখ হাসিনা তিন মেয়াদে ১২ বছরের ওপরে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন, যেটিও মেয়াদ ও সময়কালের দিক থেকে রেকর্ড। অপরদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুই মেয়াদে এবং ১০ বছরের মতো বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ সাড়ে ৯ বছরের মতো এ দায়িত্ব পালন করছেন।
সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছে। বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে প্রমত্ত পদ্মার বুকে দীর্ঘ সেতু। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম চালু হয়েছে মেট্রোরেল। এর মাধ্যমে বৈদ্যুতিক রেল ব্যবস্থারও সূত্রপাত ঘটে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ, নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হয়েছে শেখ হাসিনার হাত ধরেই।
নানামুখী ষড়যন্ত্র ও সংকট মোকাবিলা করে তিনি শুধু দেশকে সামনে থেকে নেতৃত্বই দিচ্ছেন না, টিকিয়ে রেখেছেন মানুষের আশা। তার দূরদর্শী ভূমিকায় করোনা মহামারির মাঝেও দেশের অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে সক্ষম হয়েছেন। ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা মোকাবিলা করেও দেশের অগ্রযাত্রাকে ধরে রেখেছেন। তার নেতৃত্ব দেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রশংসিত হচ্ছেন বিশ্বদরবারেও।
তবে বর্ণাঢ্য সংগ্রামমুখর এই কর্মময় জীবন কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, ছিল কণ্টকাকীর্ণও। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি গৃহবন্দি থেকেছেন। সামরিক স্বৈরশাসনামলেও বেশ কয়েকবার তাকে কারা নির্যাতন ভোগ ও গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে। বারবার তার জীবনের ওপর ঝুঁকি নেমে এসেছে। অন্তত ১৯ বার তাকে হত্যার অপচেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অসীম সাহসে লক্ষ্য অর্জনে তিনি অবিচল।
শেখ হাসিনার নেতৃত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘রাজনীতির ক্ষেত্রে তার অর্জন বলতে গেলে বলতে হবে, শেখ হাসিনা তার দলকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ দলে পরিণত করতে পেরেছেন। সরকারের স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে তার সাফল্য নিশ্চিতভাবে ঈর্ষণীয়। আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার স্কেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে ক্রেডিট দিতেই হবে। বর্তমানে তার দল অনেক বেশি শক্তিশালী এবং তার অধীনে একাট্টা।’
শেখ হাসিনা না থাকলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের কী হবে, সেটি ভাবনার বিষয় বলেও মন্তব্য করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর শাসনামলের অগ্রগতি সারা বিশ্বে আলোচিত। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বৈষম্যটা বেশ বেড়েছে। অবশ্য বৈষম্যের বিষয়টি শুধু বাংলাদেশের নয়, এটা বৈশ্বিক সমস্যা। সমাজের মধ্যে বোধহয় বাঙালিত্ব মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। এই জায়গায় বিষয়টি নতুন করে লক্ষ করার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে ফিরিয়ে আনতে সংগ্রাম শুরু করেন। সেই পথ ধরে তিনি এগিয়ে চলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে পৌঁছাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তিনি সামনের দিনগুলোতে ১৮ কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।’
দলের নেতৃত্ব হিসেবে শেখ হাসিনা শতভাগ সফল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘১৯৮১ সাল থেকে আজকের ২০২৩ সাল পর্যন্ত পুরোটা সময় তিনি আওয়ামী লীগের মতো দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ভিন্ন কোনও পথ নয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তিনি বারবার এ পদে নির্বাচিত হয়েছেন। দলের কাউন্সিলই তাকে দায়িত্ব দিয়ে আসছেন। একাধিকবার তিনি বিদায় নিতে চাইলেও দল তাকে ছাড়ছে না। দলের ভেতরে ও বাইরে শেখ হাসিনার কোনও বিকল্প নেই। আমি মনে করি, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য শেখ হাসিনা অবিকল্প হিসেবে অবস্থান করছেন।’
আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘শেখ হাসিনার নানামুখী অর্জনের স্বীকৃতি আজ বিশ্বনেতারাও দিচ্ছেন। তিনি বিভিন্ন সেক্টরে অবদান রাখায় আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত হচ্ছেন। গ্রামের দরিদ্র মানুষের জন্য তিনি কমিউনিটি ক্লিনিক করেছিলেন, সেটা এখন জাতিসংঘে শেখ হাসিনার ইনিশিয়েটিভ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।’