uncategory

‘শহীদ রুমী’ তারুণ্যদীপ্ত এক চেতনার নাম’

Gonojagoron-bg-120130328222448ঢাকা জার্নাল: আজ ২৯মার্চ।তারুণ্যদীপ্ত এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের জন্মদিন।

ভাবছি আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তবে বয়স কত হত? তিনি কি বুয়েট থেকে কিংবা আমেরিকার IIT থেকে কৃতিত্বের সাথে পাশ করে একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে অবসর নিয়ে দেশ-বিদেশের সেমিনার কনফারেন্স মাতিয়ে রাখতেন? নাকি অর্থনীতি বিষয়টির ওপর যে বিশেষ আগ্রহের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করেছিলেন, সেই অর্থনীতির বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে খোলা কলমে লিখে যেতেন পত্রপত্রিকায়? নাকি দেশের রাজনৈতিক এই চরম অস্থিরতায় সঠিক দিক-নির্দেশনা দিয়ে সুস্থির বাংলাদেশ গড়ার জন্য অগ্রণী ভূমিকা রাখতেন? কি করতেন তিনি? না, উত্তর জানা নেই কারো।

তবে কোটি কোটি বাঙালি সবাই জানে তিনি কি ছিলেন? তিনি আমাদের জন্য কি রেখে গেছেন? ১৯৫১ সালের ২৯মার্চ ইঞ্জিনিয়ার শরিফ ইমাম ও জাহানারা ইমাম দম্পতির ঘরে জন্ম নেওয়া ফুটফুটে শিশুটির পোশাকি নাম রাখা হয়েছিল শফি ইমাম। প্রিয় কবি জালালুদ্দিন রুমীর মতো জ্ঞানী ও দার্শনিক হবে এই চিন্তা করেই শিশুটির ডাকনাম রাখা হয়েছিল রুমী।

ফুটফুটে শিশুটি পিতামাতা ও পরিবার পরিজনের স্নেহছায়ায় ক্রমশই শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে উপনীত হয়েছিলেন। পড়াশুনা ও খেলাধুলায় অসম্ভব প্রতিভাবান ও চৌকস সেই তরুণ ছিলেন স্পষ্টভাষী, সাহসী, ও দৃঢ়চিত্তের অধিকারী। কুড়িতে পা রাখা অসম্ভব প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর সেই তরুণ তাঁর প্রাণপ্রিয় পিতামাতার মতই ছিলেন রাজনীতি সচেতন।

একাত্তরের ২৫মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অতর্কিত হামলায় যেদিন ঘুমন্ত বাংলা ক্ষতবিক্ষত হয়, সেদিনের সেই কালোরাতকে চিরতরে দূর করে প্রিয় দেশকে উজ্জ্বল আলোর মুখ দেখাবে বলে যাঁরা মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তরুণ রুমী ছিলেন অন্যতম ।

আমেরিকার Illinois Institute of Technology তে পড়াশুনা করে তিনি স্বচ্ছল ও নির্ঝন্ঝাট জীবন গড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের হাতছানি উপেক্ষা করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সেই তরুণ মায়ের কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন যুদ্ধে যাবার। দেশের মানুষকে বর্বর পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত করে এক টুকরো মানচিত্র উপহার দেবেন জন্য মায়ের কাছে আকুতি জানিয়েছিলেন। কাতরভাবে বলেছিলেন, ‘আম্মা, দেশের এ রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে।

আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব; কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনো দিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও, আম্মা?’ না, ছেলের এই আকুতি ফিরিয়ে দেবার মত মা তিনি ছিলেন না। তাইতো দৃঢ়চেতা পিতামাতার আশীর্বাদ নিয়েই তরুণ রুমী একাত্তরের ১৪জুন যুদ্ধে যাবার প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকা ছেড়ে মেলাঘরের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন।

সেখানে তিনি সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ এবং সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হায়দারের অধীনে আনুমানিক দেড় থেকে প্রায় দুই মাস কমান্ডো টাইপ গেরিলা ট্রেনিংসহ সুপার এক্সপ্লোসিভ বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। কঠোর প্রশিক্ষণ শেষে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে অন্য গেরিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে তরুণ রুমী ঢাকায় প্রবেশ করেছিলেন। রুমীর সহযোদ্ধা হাবিবুল আলম, বীর প্রতীকের ভাষায়, ঢাকা প্রবেশের পরে কিছু অ্যাকশনের সঙ্গে জড়িত থাকার পর রুমী ২৯ আগস্ট পাকিস্তানি আর্মি কর্তৃক ধরা পড়েন। ধরা পড়ার মাত্র চারদিন আগে ২৫ আগস্ট রুমীসহ আরও পাঁচজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ধানমন্ডির ২৮ নম্বরে দুর্ধর্ষ গেরিলা অপারেশন সম্পন্ন করেছিলেন।

সেদিন বেশ কিছুসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা হত্যার পর পাকিস্তানি আর্মিদের একটি জিপ তাঁদের অনুসরণ করলে রুমী তাঁর স্টেনগানের বাঁট দিয়ে গাড়ির পেছনের কাঁচ ভেঙে ফায়ার করে আর্মির চালককে গুলিবিদ্ধ করেন। এর ফলে পাক আর্মির জিপটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। রুমীর সাহসিকতা ও প্রত্যুৎপন্নমতিতার কারণে সেদিন তাঁর সহযোদ্ধাদের জীবন রক্ষা পেয়েছিল। ২৯ আগস্ট রুমী গিয়েছিলেন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে তাঁদের বাসায়।

আনুমানিক রাত ১২টার দিকে তাঁর বাসভবন থেকে রুমীসহ বাবা শরীফ ইমাম, ছোট ভাই জামী, বন্ধু হাফিজ, চাচাতো ভাই মাসুমসহ সকলকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে সাহসী বীর রুমী তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের কোনো কিছু স্বীকার করতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। পাক আর্মির অমানুষিক অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করেও তিনি তাঁর সহযোদ্ধাদের নাম-অবস্থান প্রকাশ করেননি। সকল দায়ভার নিজের ওপর নিয়ে রুমী তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের ছেড়ে দেবার জন্য হানাদারদের সম্মত করতে পেরেছিলেন। তাইতো ধরা পড়ার দুই দিন পর হানাদার বাহিনী সবাইকে ছেড়ে দিলেও তরুণ রুমীকে আর ফিরিয়ে দেয়নি।

আমরা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারি, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কি অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ২০ বছরের টগবগে সেই তরুণ। রুমী তাই তারুণ্যদীপ্ত এক চেতনার নাম। তাইতো ২০১৩ তে এসে স্বাধীনতার এতগুলো বছর পেরিয়েও যখন যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রলম্বিত হয়, বিচারের রায় দেখে যখন হতাশা পেয়ে বসে, তখন স্বাধীন বাংলার তরুণেরা শহীদ রুমীর তারুণ্যকে আদর্শ মেনে পুনরায় উদ্দীপ্ত হয়।

গণজাগরণ মঞ্চে শহীদ রুমী স্কোয়াডে আমরণ অনশনের শক্তি যোগায় সেদিনের সেই তরুণ রুমীর দৃঢ়চেতা অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে মাথা নত না করা দৃপ্তভঙ্গিমা। শহীদ রুমী তাই শুধু একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাই নন, তিনি স্বাধীন বাংলার তরুণদের কাছে তারুণ্যেদীপ্ত এক উজ্জ্বল চেতনার নাম।

 লেখক-

zinia-zahid-sm20130327210839

 

 

 

 

জিনিয়া জাহিদ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ব্লগার।

ঢাকা জার্নাল, মার্চ ২৯, ২০১৩

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.