শব্দদূষণ শিশু স্বস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করছে
শিউলী দাস: গুনগুনের সয়স ৭ মাসের বেশি হবে না মনে হলো। বাবার কোলে বসে হাত পা ছুঁড়ছিল সে। পাশেই বসা ছিল মা। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম ঘুমিয়ে পড়ল গুনগুন। হঠাৎ গাড়ির বিকট হর্নের শব্দে গুনগুন কেঁপে চোখ বড় বড় করে তাকাল। মা বুকের কাছে আগলে রাখলেন। কিন্তু তার কান্না থামছিল না মোটেই। উপরন্ত গাড়িটি জ্যামের মধ্যে থেকেও শুধু হর্ন দিয়ে যাচ্ছিল। চেয়ে দেখলাম, নিরূপায় মা-বাবা বাচ্চাটাকে থামাতে চেষ্টা করছিলেন।
আজকাল বাইরে বের হলে হর্নের ভয়ঙ্কর শব্দে সবার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে বাসস্থানের সংখ্যা বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। কিন্তু যানবাহনের গুণগত মান সে অনুপাতে বাড়েনি। মান্ধাতার আমলের গাড়িকে নতুন করে রং দিয়ে রাস্তায় নামানো হচ্ছে। এই গাড়িগুলোতে যেসব হর্ন ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোও অনেক পুরোনো। শব্দ ছাড়া মানুষ চলতে পারে না সত্য। কথা বলা থেকে শুরু করে গান শোনা, সিনেমা দেখা সবকিছু শব্দের মাধ্যমেই হয়। কিন্তু সেটা যখন মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছে সেটাই তখন আমাদের জন্য শব্দদূষণ হয়ে দাঁড়ায়।
ঢাকা শহরে এই মাত্রা ইতোমধ্যে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশ্বস^াস্থ্য সংস্থার মতে ৬০ ডেসিবল শব্দ একজন মানুষকে বধির করে দিতে পারে এবং ১০০ ডেসিবল শব্দে হতে পারে স্থায়ীভাবে বধির। ঢাকা শহরের রাস্তাতে সাধারণত মানুষ ৮৫ ডেসিবলে শব্দ শুনতে অভ্যস্ত। শহরের ব্যস্ততম সড়ক কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউতে দেখা গেছে একটি মোটর সাইকেল অন্য গাড়িকে অতিক্রম করতে প্রতি সেকেন্ডে ১টির বেশি হর্ন দেয়। অন্য গাড়িও কারণে Ñ অকারণে হর্ন দেয়, যা একজন সুস্থ মানুষের সহ্যসীমার বাইরে। আর শিশুর পক্ষে তো তা কোনোভাবেই সহনীয় নয়, যা তার জীবনে স্থায়ী ক্ষতি সাধন করতে হবে। শব্দদূষণ শিশুর বুদ্ধিমত্তার বিকাশকে ব্যাহত করতে পারে। তার কানসহ ফুসফুস, হৃদপিণ্ডের ক্ষতি করতে পারে। বেশি শব্দের কারণে গর্ভস্থ সন্তান পঙ্গু, বিকলাঙ্গ ও অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করতে পারে।
এসব শব্দের অধিকাংশই মানুষের তৈরি। টেলিভিশন, ক্যাসেটপ্লেয়ার, মিলকারখানার শব্দ থেকে রক্তচাপ, মাথাব্যাথা, আলসার, নিদ্রাহীনতা প্রভৃতি রোগ দেখা দিতে পারে। প্রতিদিন ঢাকা শহরে চিকিৎসা, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি বিভিন্ন কাজের প্রয়োজনে শিশুরা বাইরে বের হয়। বাইরে বের হলে মোটর সাইকেল, ট্যাক্সিক্যাবের তীব্র হর্নের জন্য জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যায়।
পরিবেশবিভাগ পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকায় ৪৫টি এলাকার মধ্যে ২৯টি এলাকায় শব্দদূষণের মাত্রা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি। এই শব্দদূষণের মধ্যে বিভিন্ন যানবাহন ছাড়াও আছে শিল্পকারখানার শব্দ, ট্রেনের শব্দ, মাইকিং, সাউন্ডস্পিকারের শব্দ, ওয়েল্ডিং, বিভিন্ন নির্মাণ কাজ চলাকালীন শব্দ যা বড়দের পাশাপাশি শিশুদেরও অধিক মাত্রায় ক্ষতি সাধন করে।
কানের মধ্যকার সেলের ক্ষতি হতে পারে মাত্রাতিরিক্ত শব্দের জন্য। এই ক্ষতি হতে পারে এত অধিক মাত্রায় যে পরবর্তীতে তা চিকিৎসা করলেও সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এছাড়া যেসব শিশু ওয়েল্ডিং-এর কাজ করে তাদের চোখের পাশাপাশি কানের পর্দার ক্ষতি হতে পারে। যে গর্ভবতী মা প্রচুর শব্দের মধ্যে থাকেন, তার গর্ভের ভ্রুণেরও ক্ষতি হয়। শব্দ দূষণের কারণে অস্থিরতা, মানসিক বৈকল্য, মাথাব্যাথা, হার্টবিট উঠানামা, মনোরোগ, আচরণগত ও আবেগীয় পরিবর্তন হতে পারে একটি শিশুর। নগরের বিভিন্ন সড়কে হর্নের তীব্রতা
কমাতে ডিএমপি কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল। ২০০৭ এর ফ্রেব্র“য়ারি মাসে ডিএমপি নগরের কয়েকটি সড়কে হর্ন বাজানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ অনুযায়ী শহরের ভিআইপি এলাকায় হর্ন বাজানো নিষেধ। কিন্তু এ নির্দেশগুলো ঠিকভাবে মানা হয় কি না সেগুলো মনিটরিং করা জরুরি।
শব্দদূষণ একটি ভয়াবহ সমস্যার রূপ নেওয়ার আগেই এখনই আমাদের করণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে ভাবতে হবে। ঢাকা শহরের ট্রাফিক পুলিশকে গাড়ি চলাচলের নিয়মকানুনসহ হর্নের কুফলের দিকে লক্ষ্য রেখে নির্দেশনা দিতে হবে। শুধু হর্নকে রুখতে বিশেষ নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করতে হবে। চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা জরুরি। হর্নের অপকারিতা সম্পর্কে লিফলেট বিলি করা যেতে পারে। জরিমানার বিধানও রাখা যেতে পারে। আবাসিক এলাকা থেকে শিল্পকারখানা দূরে স্থাপন করা যেতে পারে। পথের মোড়ে হর্ন বাজানো নিষেধ সম্বলিত বিজ্ঞাপন সংযোজন করা যেতে পারে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইনের সঠিক বাস্তবায়ন করা জরুরি। এ আইন অনুযায়ী সরকারি সকল হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস ও জাতীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহ শব্দদূষণের আওতামুক্ত থাকবে। এসব প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে কোনো হর্ন দেওয়া যাবে না। এ ব্যাপারে জনগণের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।
এ আইনে আবাসিক এলাকায় ৫০০ মিটারের মধ্যে হর্ন বাজানো নিষেধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে এসব এলাকায় ইট ভাঙার মেশিনের ব্যবহার। আইন না মানলে ৫০০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১ মাস কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে মর্মে বিধান রয়েছে। একই ধরনের অপরাধ দ্বিতীয়বার ঘটালে ১০০০০ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু দেখা যায় আবাসিক এলাকায় অনেক সময় নির্মাণ কাজ চলছে, দিনভর সেখানে ইট ভাঙার কাজ চলছে, যার ফলে বড়দের সাথে সথে শিশুদের মানসিক ও স্বাস্থ্যগত উভয় ধরনের ক্ষতিই হচ্ছে।
শিশুরাই আগামীতে দেশকে গড়ে তুলবে। তাদের জন্য বাসযোগ্য আবাস গড়তে শব্দদূষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া খুব প্রয়োজন। শিশুর সুস্থ ও পরিপূর্ণ বিকাশে শান্ত ও সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে এবং তা আজ থেকেই। – পিআইডি ফিচার
ঢাকা জার্নাল, আগস্ট ২০, ২০১৩।