রামপাল প্রকল্প বিতর্ক : এখনও মেলেনি ‘লোকেশন ক্লিয়ারেন্স’
ঢাকা : ভূমি ভরাট এবং রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো নির্মাণ চলছে পুরোদমে, এমনকি ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। কিন্তু বিতর্ক লেগেই আছে দেশের বহুল আলোচিত-সমালোচিত রামপাল প্রকল্পে। সুন্দরবনের জন্য ‘হুমকি’ বলে বিবেচিত এ প্রকল্প নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে।
এ প্রকল্পের ‘স্বার্থ চুক্তি’, পরিবেশের ক্ষতির সম্ভাবনা প্রভৃতি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয় জানানো হলেও দেখা মিলেছে ‘নতুন অসঙ্গতি’। সবকিছু চূড়ান্ত হলেও প্রকল্পটির জন্য এখনো স্থান সংক্রান্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের অনাপত্তিপত্র (লোকেশন ক্লিয়ারেন্স) মেলেনি। ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বিনিয়োগের প্রকল্পটির জন্য এখনো ভূমি লিজের চুক্তি (এলএলএ) হয়নি। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, ‘অনুমতি দেয়া হয়েছে।’
চলতি মাসের ১ তারিখ বিদ্যুৎ প্রকল্পটির জন্য গঠিত বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বিদ্যুৎ কোম্পানি লি. (বিআইএফপিসিএল) স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সেই বৈঠকে বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলাম বলেন, ‘দ্রুত লোকেশন ক্লিয়ারেন্স এর উদ্যোগ নিতে হবে।’
তবে সোমবার রাতে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক নাজমুল আহসান জানান, লোকেশন ক্লিয়ারেন্স দেয়া হয়েছে।
এছাড়া প্রকল্প এলাকার ভূমি জরিপও সম্পন্ন হয়নি। ডিসেম্বরের মধ্যে এ বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রামপালের সাপমারী কাটাখালী ও কৈগরদাসকাঠি মৌজায় ১ হাজার ৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করে তা উন্নয়নের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। সম্প্রতি রামপালে প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায় ভূমি উন্নয়নের কাজ প্রায় শেষ। চলছে প্রাথমিক অবকাঠামো নির্মাণের কাজ।
লোকেশন ক্লিয়ারেন্স ছাড়াই এসব কার্যক্রমের বিরোধিতা করছেন স্বংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. আবদুল মতিন বলেন, ‘রামপালের জন্য যে পরিবেশ পর্যালোচনা (ইআইএ রিপোর্ট) করা হয়েছে তার সত্যতা নেই। ইআইএ চূড়ান্ত না করে কাজ করা যায় না, কিন্তু এখানে আগেই কাজ শুরু হয়েছে।’
সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার প্রাপ্ত প্রকল্প এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প। এ প্রকল্পের শুর থেকেই পরিবেশবাদীদের বিরোধিতার মুখে পড়েছে। তাদের অভিযোগ সুন্দরবনের কাছে এ ধরনের বড় স্থাপনা বনের পরিবেশের ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলবে। যদিও সরকার বলছে, ইউনেস্কো ঘোষিত আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য এলাকা থেকে বিদ্যুত কেন্দ্রটি ৬৯ কিলোমিটার দূরে এবং সুন্দরবনের প্রান্ত সীমা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হওয়ায় এ প্রকল্পে বনের কোনো ক্ষতি হবে না। এছাড়া পরিবেশের সুরক্ষায় সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই রামপাল কেন্দ্র নির্মিত হবে।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের আলোচনা হয়। একই বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সচিব এবং ভারতের বিদ্যুৎ সচিবের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) হয়। এররই ধারবাহিকতায় ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশনের (এনটিপিসি) মধ্যে একটি যৌথ বিনিয়োগ কোম্পানি গঠনের চুক্তি হয়। একই বছরের ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশ ভারত মৈত্রি বিদ্যুত কোম্পানি ৯ বিআইএফপিসিএল) গঠিত হয়। যাতে পিডিবি ও এনটিপিসির সমান শেয়ার রয়েছে। এরপর ২০১৩ সালে ২০ এপ্রিল ঢাকায় পিডিবি, এনটিপিসি ও বিআইএফপিসিএল এর মধ্যে যৌথ উদ্যোগ চুক্তি, বাস্তবায়ন চুক্তি ও বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি সম্পাদিত হয়। আর ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রামপালের সাপমারী কাটাখালী ও কৈগরদাসকাঠি মৌজায় এক হাজার ৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করে তা উন্নয়নের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ঠিকাদার নিয়োগে আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকা হয়েছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আহবান করা দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় তিন দফা বাড়িয়ে ২২ সেপ্টম্বর নির্ধারণ করা হয়। শেষ দিকে তিনটি দরপ্রস্তাব জমা পড়েছে। জাপানের ‘মারুবেনি করপোরেশন’ ও ভারতের ‘লারসর এণ্ড টুবরো লিমিটেড’ – এই দুই কোম্পানি যৌথভাবে দরপ্রস্তাব জমা দিয়েছে। চিনের ‘হারবিন ইলেকট্রিক কোম্পানি লি.’ ‘ইটিইআরএন’ ও ফ্রান্সের আলসটম – এই তিন কোম্পানি যৌথভাবে জমা দিয়েছে। এছাড়া ভারত হেভি ইলেক্ট্রিক্যালস্ লিমিটেড (ভেল) এককভাবে দরপ্রস্তাব জমা দিয়েছে। কেন্দ্র নির্মাণে এনটিপিসি ও পিডিবি প্রকল্পটিতে ৩০ ভাগ অর্থ বিনিয়োগ করবে। বাকি ৭০ ভাগ অর্থ ঋণ হিসেবে সংগ্রহ করবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান।
সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে পাল-১৩২০ মেগাওয়াট প্রকল্পর প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে ২০১৮-এর ডিসেম্বরের মধ্যে। সরকার বলছে, ইউনেস্কো ঘোষিত আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য এলাকা থেকে বিদ্যুত কেন্দ্রটি ৬৯ কিলোমিটার দূরে এবং সুন্দরবনের প্রান্ত সীমা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হওয়ায় এ প্রকল্পে বনের কোনো ক্ষতি হবে না।