রাজস্ব ব্যবস্থাপনা যেন নিবর্তনমূলক না হয়
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
বাংলাদেশের কর ব্যবস্থাপনা যে নিপীড়নমূলক তার কিছুটা আভাস দিয়েছেন বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। শনিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছেন, কর দাতারা যেন রাজস্ব কর্মকর্তাদের দেখে আতংকিত না হন। তিনি এও বলেছেন যে, সরকারের অর্থ প্রয়োজন। এজন্য বেশি করে রাজস্ব আদায় করতে হবে। তবে তা মানুষকে কষ্ট দিয়ে নয়।
তাঁর এই বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। বিগত আওয়ামী সরকার অর্থনীতিতে যে ব্যবস্থাপনা রেখে গেছে তার বৈশিষ্ট্য হলো, সরকারের আয় কম, ব্যয় বেশি। বলতে গেলে শেখ হাসিনার পুরো শাসনামলেই বড় কাঠামোগত সমস্যা ছিল এটাই যে, সরকার পরিচালনার জন্য বিপুল ব্যয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়েনি না রাজস্ব আয়। আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত আট বা সাড়ে আট শতাংশ যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন।
আমাদের মূল সমস্যা কর ব্যবস্থাপনায়। শেখ হাসিনার সরকার সরকার রাজস্ব আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে গতানুগতিক পন্থায় চলেছে সব সময়। আর সেটা হলো ভ্যাটসহ পরোক্ষ কর বাড়ানো। এই ব্যবস্থা দরিদ্রবিরোধী, ধনিকশ্রণি বান্ধব। রাজস্ব আয়ে পরোক্ষ করের অবদান এরই মধ্যে ৭০-৮০ শতাংশ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় প্রগতিশীল আয়কর ও সম্পদ কর আরোপ করে ধনীদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করতে না পারায় অর্থনীতিতে ন্যায্যতা আসেনি। বৈষম্য ক্রমাগত বাড়তে থাকায় আয় ও সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কাছে।
বাংলাদেশে পরোক্ষ এবং পরোক্ষ কর ব্যবস্থাপনা একই মন্ত্রণালয় এবং একজন প্রশাসনিক চেয়ারম্যানের অধীনে যার নাম জাতীয় রাজস্ব বোর্ড । আমাদের পাশের দেশ ভারতে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ কর প্রশাসন আলাদা। সেখানে প্রত্যক্ষ কর, অর্থাৎ আয়কর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আর পরোক্ষ কর (ভ্যাট) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আবার অর্থমন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকেও কর বিভাগ বাস্তবায়নকারী হিসেবে স্বশাসিত। বাংলাদেশে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার একটি বড় দিক হলো এখানে নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন এক হাতে হয়। ফলে কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ডিসক্রিশনারি ক্ষমতা একচ্ছত্র। ফলে এখানে আইনের ব্যাখ্যার চাইতে ব্যক্তি কর্মকর্তার ইচ্ছাই প্রবল হয়ে উঠে এবং সিস্টেম পুরোটাই নিবর্তনমূলক হয়ে উঠেছে যার কথা অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন।
কেন পরোক্ষ কর ব্যবস্থাপনা বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখতে হবে তার বড় কারণ হলো দ্রব্যমূল্য ও আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করে এই মন্ত্রণালয়। এর সাথে যেহেতু শুল্ক এবং মূল্য সংযোজন করের বিষয় জড়িত তাই শুল্ক এবং ভ্যাট দপ্তর এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসাই যৌক্তিক। আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো মূল্য নির্ধারণ করে ট্যারিফ কমিশন যা বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে আর শুল্ক হার ঠিক করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ট্যারিফ কমিশনকে আমলে নেয় না।
সবাই বলছে যে, কর কাঠামোতে বড় সংস্কার আনতে হবে,পেশাদারিত্ব বাড়াতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে,কর প্রশাসনের দক্ষতা বাড়াতে হবে,করের ভিত্তিকে বদলাতে হবে এবং করের অনুপাত জিডিপির ২০ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে যা বর্তমান বছরের বাজেটে জিডিপির ১৪ দশমিক ২০ শতাংশ মাত্র। আর সেটা নিয়ে যেতে পারলে বাজেটের আকারও জিডিপির ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
আইএমএফ রাজস্ব খাতে সংস্কারের যে কথা বলেছে তার অন্যতম হলো আয়কর,মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং শুল্ক খাতে বছরের পর বছর যেসব কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা কমাতে হবে।
বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ সামর্থ্যের অর্ধেকেরও কম। রাজস্ব আহরণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হওয়ায় অবকাঠামো উন্নয়ন,মানবপুঁজি গঠন,সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয় কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় উন্নয়নে পর্যাপ্ত অর্থের জোগান অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে রাজস্ব আহরণ হতাশাজনক। কর-জিডিপি অনুপাতের ক্ষেত্রে একেবারে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশ। বহুবছর ধরে জিডিপির অনুপাতে করের অংশ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সেভাবে কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
কর কর্মকর্তাদের প্রতি করদাতাদের আস্থার সংকট প্রকট। রাজস্ব আহরণ কর্তৃপক্ষের প্রতি আস্থার ঘাটতির কারণে ব্যক্তি এবং প্রাতিষ্ঠানিক করদাতারা নিরুৎসাহিত হন। রিটার্ন দাখিলে সম্পদের তথ্য ঘোষণার ক্ষেত্রে অনেকে হয়রানির শিকার হন। দেখা গেছে যে কোম্পানি বা ব্যক্তি নিয়মিত কর দিচ্ছে তাদের ওপরই বারবার চেপে বসছে এনবিআর। যারা ফাঁকি দিচ্ছে তারা নিরাপদ থাকছে।
একটি বড় দুর্বলতা হলো আয়করযোগ্য হলেও অনেক মানুষ নিয়মিত কর দেন না। রাজস্ব বাড়াতে আয়কর আদায়ে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। তাই রাজস্ব খাতে সংস্কার আনার এখনই উপযুক্ত সময় বলে মত দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। কর প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত করা,কর আদায় ব্যবস্থা অটোমেটেড বা স্বয়ংক্রিয় করাসহ বিভিন্ন সংস্কারে হাত দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। নতুন সরকার এসেছে। এখন রাজস্ব খাত সংস্কারের সময়।
লেখক: সাংবাদিক