মিয়ানমারে দুর্বল হয়ে পড়ছে জান্তার নিয়ন্ত্রণ
মিয়ানমারে জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সমন্বিত অভিযান ‘অপারেশন ১০২৭’ শুরু হওয়ার পর থেকে শুধু শান রাজ্যেই ৪ শতাধিক সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা আত্মসমর্পণ বা পালিয়েছে। মিয়ানমার-বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর সংকলিত তথ্য অনুসারে, শান, কায়াহ, চিন, রাখাইন, মন রাজ্য এবং সাগাইং ও মাগওয়ে অঞ্চলে ২৭ অক্টোবরের পর হতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৪৪৭ জন সেনা আত্মসমর্পণ করেছে। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, কারণ প্রতিনিয়ত সেনারা নিজেদের ফাঁড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে।
তিনটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘অপারেশন ১০২৭’ শুরু করেছে। তারা ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ জোট গড়ে এই সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করছে। এই জোটে রয়েছে তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি। শুক্রবার তারা দাবি করেছে, ২৭ অক্টোবর থেকে তাদের অভিযানে শতাধিক সেনা নিহত বা আহত এবং তিন শতাধিক সেনা আত্মসমর্পণ করেছে।
তাদের দাবি মতে, ১২ নভেম্বর লুকাইং টাউনশিপে মেজর কিয়াউ ইয়ে অংয়ের নেতৃত্বে লাইফ ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন ১২৯-এর ১২৭ জন সেনা ও ১৩৪ জন সেনাদের আত্মীয় আত্মসমর্পণ করে।
ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স জানিয়েছে, প্রত্যেক দলত্যাগী সেনাদের ১ মিলিয়ন কিয়াত (৪৭৬ ডলার) দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার তারা জান্তার সব সেনাদের আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছে।
ব্রাদারহুড জোটের আরেক বাহিনী মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) জানিয়েছে, ৩০ অক্টোবর ৪১ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ১৪৩ জন সেনা তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ৩১ অক্টোবর চীন সীমান্তের ককাং অঞ্চলে জান্তাপন্থি অন্তত ১৫ মিলিশিয়াও আত্মসমর্পণ করেছে তাদের কাছে।
আত্মসমর্পণকারী সেনাদের নিজের পরিবারের কাছে যাওয়ার যাতায়াত খরচ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে এমনডিএএ।
ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স বলছে, এখন পর্যন্ত তারা জান্তা বাহিনীর দেড় শতাধিক ফাঁড়ি-ঘাঁটি ও ছয়টি শহর দখল করেছে।
সামরিক শাসনবিরোধী গণতন্ত্রপন্থিদের বিপ্লবী সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি)-এর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইউ মাউং মাউং সোয়ে দাবি করেছেন, জান্তার সেনারা পালাচ্ছে, নিহত হচ্ছে ও আত্মসমর্পণ করছে। তিনি বলেন, সেনা কমান্ডাররা মিথ্যাচার করছে, তারা হেরে যাবে এটি বুঝতে পারছে। তারা যদি জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইংকে রক্ষা করতে না পারে তাহলে নিজেরা ও পরিবারকে বিপদে ফেলবে।
মুখপাত্র দাবি করেছেন, জান্তার সেনাদের একাধিক ইউনিট পক্ষত্যাগের জন্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তবে তিনি বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
কায়াহ রাজ্যে চলতি সপ্তাহে ৩৮ সেনা আত্মসমর্পণ করেছে। রাজ্যের রাজধানীতে লইকাউ বিশ্ববিদ্যালয়ে জান্তার বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে অন্তত ১১০ সেনা নিহত হয়েছে।
কারেন্নি ন্যাশনালিটিজ ডিফেন্স ফোর্স বলেছে, সেনাদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
চিন রাজ্যে ভারত সীমান্তের ফালাম টাউনশিপের রেহ খাউ ডা সীমান্ত শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে প্রতিরোধ বাহিনী। এখানে এক মেজরসহ ৭ সেনা আত্মসমর্পণ করেছে।
রয়টার্স জানিয়েছে, মিয়ানমারে পালিয়েছে প্রায় ৪৩ সেনা। পরে বৃহস্পতিবার আরও ২৯ সেনা সীমান্ত অতিক্রম করেছে।
মন রাজ্যে কিয়াকমায়াউ টাউনশিপে প্রতিরোধ বাহিনীর কাছে ২৩ সেনা আত্মসমর্পণ করেছে। লড়াইয়ে এক ব্যাটালিয়ন কমান্ডারসহ ১৪ সেনা নিহত ও ৫ জন বন্দি হয়েছে।
রাখাইনে মিয়ানমারের সেনারা গত সোমবার প্রায় ৪০টি অবস্থান থেকে পালিয়েছে আরাকান আর্মির হামলার পর। গোষ্ঠীটি দাবি করেছে, কিয়াকতাউ টাউনশিপে ২২ জন সেনা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেছে। এছাড়া আরও দুটি পুলিশ ফাঁড়ির ছয় পুলিশ সদস্য আত্মসমর্পণ করেছে। পরে বুধবার রাতে পাউকতাউ টাউনশিপের আরও ৩০ সেনা আত্মসমর্পণ করে।
এছাড়া সাগাইং অঞ্চলের কাউলিন, কালাউ, সালিঙ্গি, মাগওয়ে অঞ্চলে গাঙ্গাউ টাউনশিপে এবং বাগো অঞ্চলে শেগুইন অঞ্চলে একাধিক ফাঁড়ি ছেড়েছে সেনারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সামরিক বিশ্লেষক বলেছেন, জান্তার সেনাদের লড়াইয়ের মনোবল নেই। কারণ তাদের পক্ষে জনসমর্থন নেই, ব্যর্থতা বাড়ছে এবং সেনা মোতায়েন বাড়াতে পারছে না সামরিক সরকার।
তার মতে, পরাজয়ে সেনাদের মনোবল ভেঙে পড়ে। শান রাজ্যে তারা বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে এবং মনোবল একেবারে তলানীতে।
তিনি বলছেন, আগামী দিনগুলোতে সেনাদের আত্মসমর্পণ ও পক্ষত্যাগ আরও বাড়বে।
সম্প্রতি সামরিক সরকারের মুখপাত্র জেনারেল ঝাউ মিন তুন বলেছেন, সেনারা ফাঁড়ি পরিত্যাগ করায় ছোট ছোট ফাঁড়িগুলোকে সমন্বিত করা হচ্ছে। তবে পক্ষত্যাগের বিষয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করেননি।