বেড়ানোর জন্য বেছে নিতে পারেন লাকসাম
ঢাকা জার্নাল: শীতকাল বেড়ানোর জন্য বেছে নিতে পারেন ছায়া সুনিবিড় ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা ওলাকসামে। গোমতী বিধৌত কুমিল্লার প্রাকৃতিক পরিবেশ, সুজলা–সুফলা শস্যক্ষেত্রে এবং ঐতিহাসিক স্থানসমূহ সমগ্রদেশের জ্ঞান পিপাসু পর্যটকদের মুগ্ধ করবে।
ঢাকা থেকে কুমিল্লা ও লাকসামে আসার জন্য আপনি রেলপথ অথবা সড়ক পথ বেছে নিতে পারেন। কমলাপুররেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে আসতে পারেন কুমিল্লা ও লাকসামে। অথবা ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে বাসেও আসতেপারেন।
নবাব ফয়জুন্নেছার বাড়ি:
লাকসামের পশ্চিমগাঁওয়ে ডাকাতিয়া নদীর তীরে দেখুন নারী জাগরণের পথিকৃৎ নবাব ফয়জুন্নেছার বাড়ি। তিনিছিলেন হোমনাবাদের জমিদার। তার জীবনকাল ১৮৩৪–১৯০৩ পর্যন্ত। এখানে ঐতিহ্যবাহী দশ গম্বুজ মসজিদওরয়েছে। ফেরার সময় দেখে আসুন দেশের উল্লেখযোগ্য লাকসাম রেলওয়ে জংশন।
লালমাই পাহাড়:
লালমাই পাহাড় নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। লংকার রাজা রাবন, রামের স্ত্রী সীতাকে হরণ করে সেখানে নিয়ে গেলেরাম তার ভাই লক্ষণকে নিয়ে উদ্ধার অভিযান চালায়। এতে লক্ষণ আহত হলে কবিরাজ বিশল্যাকরণী গাছের পাতাহিমালয় পাহাড় থেকে সূর্যোদয়ের পূর্বে এনে দেওয়ার কথা বলেন। হনুমান গাছটি চিনতে না পেরে পুরো পর্বত নিয়েআসে এবং কাজ শেষে পাহাড়টি যথা স্থানে রাখতে যাওয়ার সময় উক্ত স্থানে অনেকটা আনমনা হয়ে যায়। ফলেপাহাড়ের একাংশ লম লম সাগরে পড়ে যায়। তাই এ স্থানের নাম লালমাই রাখা হয়। এটি উত্তর দক্ষিণে ১১ মাইল লম্বাএবং পূর্ব পশ্চিমে ২ মাইল চওড়া। লাল মাটির এ পাহাড়ের সর্বোচ্চ উচ্চতা ৫০ ফুট।
ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার:
কুমিল্লা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার পিমে ময়নামতি (কোটবাড়ি) অবস্থিত। এখানে অষ্টম শতকের পুরাকীর্তিরয়েছে। ১৯৫৫ সালে এখানে খনন কাজ শুরু হয়। এখানকার বিভিন্ন স্পটের মধ্যে শালবন বিহার ও বৌদ্ধ বিহারঅন্যতম। শালবন বিহার দেখার পর ৩ মাইল উত্তরে কোটিলামুড়া দেখতে আসুন। এখানে তিনটি বৌদ্ধ স্তুপ আছে।এর ভিত্তি বেদীগুলো চার কোণাকার। কোটিলামুড়া দেখার পর এটি থেকে প্রায় দেড় মাইল উত্তর–পশ্চিমে সেনানিবাসএলাকায় রয়েছে চারপত্রমুড়া। প্রায় ৩৫ ফুট উঁচু একটি ছোট ও সমতল পাহাড়ের চুড়ায় এর অবস্থান। যা পূর্ব–পশ্চিমে১০৫ ফুট লম্বা ও উত্তরে দক্ষিণে ৫৫ ফুট চওড়া ছিল। পাহাড়পুর বিহারের পরই এর স্থান। এছাড়াও রয়েছে রূপবানমুড়া ও কোটিলা মুড়া। এখানে রয়েছে ময়নামতি যাদুঘর। যাদুঘরের পাশে বন বিভাগ নতুন ২টি পিকনিক স্পটকরেছে।
বার্ড:
১৯৫৯ সালে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়নের সূতিকাগার।বার্ডের ভিতরে প্রবেশ করতে হলে অনুমতি নিতে হবে। বার্ডের ভেতরের নয়নাভিরাম রাস্তা দিয়ে সামনে এগুলেইদেখতে পাবেন নীলাচল পাহাড়। তাছাড়া দু’পাহাড়ের মাঝখানে দেখতে পাবেন অনিন্দ্য সুন্দর বনকুটির।
চন্ডিমুড়া মন্দির:
কুমিল্লা জেলার লাকসাম, বরুড়া ও সদর থানার ত্রিমুখী মিলনস্থলে লালমাই পাহাড়ের শীর্ষ দেশে চন্ডি মন্দির অবস্থিত।এলাকাটি চন্ডিমুড়া হিসেবে পরিচিত। ত্রিপুরাধিপতির বংশধর দ্বিতীয়া দেবী প্রতিষ্ঠিত চন্ডি মন্দির ১৩ শত বছরেরইতিহাসের নীরব সাক্ষী। প্রাচীন তাম্রালিপি অনুযায়ী জানা যায়, সমতট রাজ্যটি স্থাপন করার সময় মন্দির দুটি নির্মিতহয়। কিন্তু রাজমালা গ্রন্থ অনুযায়ী জানায় যায় ১৭শ‘ শতাব্দীতে রাজা গোবিন্দ মাণিক্যের অনুজ জগন্নাথ দেবের মেয়েদুতিয়া দেবী মন্দির দু‘টি নির্মাণ করেন।
বিজয়পুর মৃৎশিল্প:
ষাটের দশকের কুমিল্লা সদর দক্ষিণের বিজয়পুর মৃৎশিল্প কারখানাটি এখনও দেশে বিদেশে কুমিল্লার খ্যাতি বৃদ্ধিকরছে। পদুয়ার বাজার বিশ্ব রোডের পাশে বিজয়পুারের অবস্থান। এখানে সুলভ মূল্যে মাটির তৈরির ফুলের টব,ফুলদানি, হাঁসটব, লম্বা ও গোর ছাইদানী, চায়ের কাপ, প্লেট ও নকশাদার বাতি, মাছ, কেঙ্গারু ইত্যাদি তৈজস কিনতেপাওয়া যায়।
রাজেশপুর ফরেস্ট:
ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা সদর দক্ষিণের লালবাগ থেকে ১ কিলোমিটার পূর্বে রাজেশপুর ফরেস্ট। এখানেফরেস্ট রেঞ্জ অফিস আছে। ইচ্ছা হলে প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নিতে পারেন। এখানে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তীনোম্যান্স ল্যান্ড দেখা যায়। পাখির কিছির মিছির শব্দে হারিয়ে যান সবুজ অরণ্যে।
শাহ্ সুজা বাদশা মসজিদ:
বাদশাহ আওরঙ্গজেবের ভাই শাহজাদা সুজার নাম অনুসারে সুজা মসজিদ নির্মিত হয়েছে। কুমিল্লা শহরের মোগলটুলিতেএর অবস্থান। ১৬৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে তার ছেলে দারা মুরাদ, সুজা ওআওরঙ্গজেব সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তখন শাহ সুজা পরাজিত হয়ে ত্রিপুরার রাজার কাছে আশ্রয় লাভ করলে পরবর্তীতেউপহার স্বরূপ সুজা একটি হিরার আংটি দিয়ে যান। ত্রিপুরার রাজা ধর্মমাণিক্য তা বিক্রি করে এই মসজিদ তৈরিকরেন।
ধর্মসাগর:
শহরের বাদুরতলায় ধর্মসাগর অবস্থিত। প্রায় সাড়ে ৫’শ বছর আগে রাজা ধর্ম মানিক্য এটি খনন করেন। এরআয়তন ২৩.১৮ একর। চার দিকে বৃক্ষ শোভিত একটি আনন্দকর স্থান। আপনি এখানে নৌকায়ও ভ্রমণ করতেপারেন।
ভাষা সৈনিকের বাড়ি:
আপনি ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিবহুল বাড়িটি দেখে যেতে ভুলবেন না। তিনিই সর্বপ্রথম ১৯৪৮ সালেবাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য কংগ্রেসের পক্ষ থেকে গণপরিষদে আহবান জানান। ১৯৭১ সালে তাকে পাক হানাদাররাহত্যা করে।
ওয়ার সিমেট্রি:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবাহী ওয়ার সিমেট্রি কুমিল্লা– সিলেট সড়কের পাশে অবস্থিত। সকাল ৭টা–১২টা এবং ১টা–৫টাপর্যন্ত এখানে প্রবেশের সুযোগ পাবেন। এখানে ব্রিটিশ, কানাডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান, নিউজিল্যান্ডিয়ান, আফ্রিকান,জাপানী, আমেরিকান এবং ভারতীয় মিলে ৭৩৭ জন সৈন্যের কবর আছে।
রাণীর বাংলো:
কুমিল্লা–সিলেট রোডের কুমিল্লা বুড়িচংয়ের সাহেব বাজারে রাণীর বাংলা অবস্থিত। সড়কের পিমে ক্ষীর নদী রয়েছে।এখানে এখনও খনন কাজ চলছে। এখানকার দেয়ালটি উত্তর দক্ষিণে ৫১০ফুট লম্বা ও ৪০০ ফুট চওড়া। এখানে স্বর্ণ ওপিতল নির্মিত দ্রবাদি পাওয়া গেছে।
ত্রিশ আউলিয়ার মাজার:
হযরত শাহ জালালের সফরসঙ্গী শাহ জামালসহ মোট ৩০ জন আউলিয়ার মাজার দেখুন কুমিল্লার দেবিদ্বার থানারএলাহাবাদ গ্রামে। পূর্ববঙ্গের আউলিয়া কাহিনী থেকে জানা যায়, হযরত শাহজালাল, শাহজামাল এবং শাহকামালকেবলেছিলেন, চলতে চলতে যেখানে গিয়ে আপনাদের উট খাড়া হবে সেখানেই আপনারা ইসলাম প্রচার করবেন। সেহিসেবে এখানে অবস্থিত কবরগুলো প্রায় ৭’শ বছরের পুরনো। এখানে ৩০টি কবর আছে।
নজরুল স্মৃতি:
কুমিল্লা শহরে রয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থান।কাজী নজরুলইসলামের স্মৃতিবাহী দৌলতপুর দেখার জন্য যেতে পারেন মুরাদনগর থানায়। এখানে নার্গিসের সাথে তার বিয়ে হয়।তিনি কুমিল্লা ও দৌলতপুরে অনেক কবিতা ও গান রচনা করেন।
নদীর নাম গোমতী:
কুমিল্লাবাসীর সুখ–দুঃখের সাথী গোমতী নদী। এটি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। শহরের পাশে বানাশুয়াব্রিজে গিয়ে গোমতীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। এছাড়া কুমিল্লা সদর উপজেলা মিলনায়তনের পাশেদেখতে পারেন কেটিটিসির পর্যটন কেন্দ্র। শহরের চর্থায় যেতে পারেন সঙ্গীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মণের বাড়ি, বাগিচাগাঁয়েরয়েছে বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের অন্যতম নেতা অতীন রায়ের বাড়ি। দেখতে পারেন কুমিল্লা পৌর পার্ক, চিড়িয়াখানাও শতবর্ষী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ।
লেখকক- সামছুল আলাম রাজন।