বাবা অথবা প্রিয় শিক্ষকের গল্প

এপ্রিল ১, ২০২০

খুব স্বাভাবিকভাবেই শৈশবে ধর্ম বিষয়টিকে আমার কাছে স্পষ্ট করতে প্রচলিত ধর্মগুলো সম্পর্কে কিছু বই-পুস্তক উনি আমাকে পড়তে দেন। এই বইগুলো পড়ে সেখান থেকে সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের ধারণা খুঁজে নিতে বলেন। একটু বড় হবার পর দর্শনের আলোকে ধর্মকে বোঝার জন্য আবার কিছু বইপুস্তক দেন পড়তে। আবার বিজ্ঞানের আলোকে বিবর্তনবাদ খুব সহজ করে বুঝে নিতে বইপুস্তক দেন। তার দেয়া বইপুস্তক পড়ার পর উনি আলোচনা করে প্রতিটি বিষয় সহজ করে বুঝতে সাহায্য করেছেন। এইসব আলোচনা থিসিস দাঁড়িয়েছে একটি বাক্যে, আমি যদি সারাজীবনে কোন মানুষের ক্ষতি না করি; পারলে উপকার করি; সেটাই মানুষের ধর্ম।

মাসকাওয়াথ আহসান

আমার বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক পিতা-পুত্রের সম্পর্ক অপেক্ষা শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক হিসেবেই বেশি অনুভূত। আমার বাবা আহসান উল্লাহ দর্শনের শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকতার প্রতি তার যে রোমান্টিকতা লক্ষ্য করেছি; তা আজো আমার কাছে বিরাট বিস্ময়।

ফলে যতদিন তার সাহচর্যে থেকেছি; আমি ছিলাম উনার ছাত্রদের মাঝে অন্যতম। উনি যখন যাকে কিছু শেখাতেন; একই রকম প্যাশন নিয়ে শেখাতেন; আর এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন অক্লান্ত। উনি শিক্ষা’র বাইরে অন্য কোন বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন না কখনোই। এ ব্যাপারে উনাকে জিজ্ঞেস করলে বলেছিলেন, উনি জেনারালাইজেশান বা সাধারণীকরণ পছন্দ করেন না; উনার পছন্দ স্পেশালাইজেশান বা বিশেষায়িতকরণ। উনার স্পেশালাইজেশান যেহেতু শিক্ষায়; উনি মনে করতেন, ছাত্রদের শিক্ষা দেয়াটা উনি যদি নিখুঁতভাবে করতে পারেন; তাহলে সেটাই উনার জন্য সবচেয়ে বড় সন্তোষের বিষয়।

অধিকাংশ মানুষই মিডিয়া বিকশিত হবার পরে সেখানে অভিমত দিতে আগ্রহী হয়েছেন। আমার বাবার এ ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখিনি; বরং উনি এটা বিনয়ের সঙ্গে এড়িয়ে গেছেন। এর কারণ জানতে চাইলে বলেন, শিক্ষা নিজেই একটা মাধ্যম; ছাত্রদেরকে উনি শ্রেণীকক্ষে যে শিক্ষা দিয়েছেন; সেটাই ছাত্রদের মাধ্যমে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে গেছে। কাজেই একজন শিক্ষকের আলাদা করে মিডিয়ায় কথা বলার প্রয়োজন নেই। উনি মনে করতেন শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের যে মাধ্যম; সেইখানে সবচেয়ে মনোযোগী শ্রোতা পাওয়া যায়।

খুব স্বাভাবিকভাবেই শৈশবে ধর্ম বিষয়টিকে আমার কাছে স্পষ্ট করতে প্রচলিত ধর্মগুলো সম্পর্কে কিছু বই-পুস্তক উনি আমাকে পড়তে দেন। এই বইগুলো পড়ে সেখান থেকে সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের ধারণা খুঁজে নিতে বলেন। একটু বড় হবার পর দর্শনের আলোকে ধর্মকে বোঝার জন্য আবার কিছু বইপুস্তক দেন পড়তে। আবার বিজ্ঞানের আলোকে বিবর্তনবাদ খুব সহজ করে বুঝে নিতে বইপুস্তক দেন। তার দেয়া বইপুস্তক পড়ার পর উনি আলোচনা করে প্রতিটি বিষয় সহজ করে বুঝতে সাহায্য করেছেন। এইসব আলোচনা থিসিস দাঁড়িয়েছে একটি বাক্যে, আমি যদি সারাজীবনে কোন মানুষের ক্ষতি না করি; পারলে উপকার করি; সেটাই মানুষের ধর্ম।

দেশপ্রেম সম্পর্কে জানতে চাইলে উনি খুব সহজ করে বলেছেন, যে যার কাজ খুব নিষ্ঠা ও সততার মাধ্যমে করলেই দেশ এগিয়ে যায়। সুতরাং কর্মনিষ্ঠতা আর সততাই দেশপ্রেম। আর রাজনীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে, প্লেটোর “রিপাবলিক” বইখানি পড়তে দেন ও তা নিয়ে আলোচনা করেন। নিজে রাজনীতিতে কোন আগ্রহ দেখাতেন না। কারণ উনি বিশ্বাস করতেন, উনার ছাত্রদের মাঝ থেকেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরী হবে। হয়েছেও তাই। উনি যে এলাকায় বসবাস করতেন; সেখানে ধীরে ধীরে দেখা গেলো উনার ছাত্রদের অনেকে রাজনীতিতে এসে জনপ্রতিনিধিত্ব করছে।

শিক্ষার বাইরে উনার আগ্রহ ও চর্চার জায়গা সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি। ছাত্রদের নিয়ে গীতিনৃত্যনাট্য-থিয়েটার-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছেন বিস্তর। এ কারণেই উনার ছাত্রদের কাছে পড়ালেখাটা অনেক আনন্দময় হয়েছে বলে মনে হয়। উনার এই আনন্দের মাঝ দিয়ে শিক্ষার কৌশল আমার শৈশব-কৈশোর-যৌবনকে আনন্দপ্রদ করেছে।

আমার বাবা তার জীবনে কয়েকজন খুব ভালো শিক্ষক পেয়েছিলেন। তাদের সাহচর্যই তার মধ্যে শিক্ষকতা পেশার মাঝে রোমান্টিসিজম এনে দিয়েছিলো।

সবশেষে আমার ছেলে আমার বাবার সাহচর্যে আসার পর; দাদা-নাতির সম্পর্কের রসায়ন আবার সেই শিক্ষক-ছাত্রের আনন্দময় অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে উনি যে আপাদমস্তক শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন; সে স্বপ্ন তার পূরণ হয়েছে। সে কারণেই হয়তো তার মাঝে প্রাণপ্রবাহের ঘাটতি দেখিনি।

এই শিক্ষক হবার স্বপ্নযাত্রায় উনি উনার পারিবারিক পুরোনো ব্যবসা
উদ্যোগ- সম্পদ-জমিজমার ক্লিশে ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষাকেই জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সম্পদ ভাবতে শিখেছেন; ছাত্রদের শিখিয়েছেন। এই বিষয়টিকে অল্পবয়েসে আমার কাছে মনে হতো, এটা আমার বাবার একটা ইউটোপিয়া বা শিক্ষকতার প্রতি রোমান্টিকতা জনিত ভ্রান্তি। তিনি বার বার যে সিম্পল লিভিং এন্ড হাই থিংকিং-এর কথা বলতেন; তা অচল দর্শন মনে হয়েছে অনেকসময়।

কিন্তু এ জগতটাকে যত বেশী দেখা হলো; যত বেশী বিস্তৃত হলো চেনা-জানার পরিসর; ততই বুঝতে পারলাম; আমার বাবা বা অন্য প্রবীন মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ যে প্রজ্ঞা; তা অমূল্য। আপাত ইউফোরিয়ায় বা ফাঁপা সমাজের চোখ ধাঁধানো জৌলুস দেখে উতলা হবার কোন কারণই নেই; কেননা এ হচ্ছে ফিল্মের আইটেম গান-এর মতো; এর স্থায়ীত্ব খুবই কম। জীবনের গভীরের জীবনকে খুঁজে পাওয়া যায় আসলে “সাদাসিধে জীবন আর বোধসম্পন্ন চিন্তার উদ্ভাসে।

ঠিক সেরকম একটা জীবন উদযাপন করে গতকাল সাঁঝে ৭৯ বছর বয়সে উনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। মার্চ ২২, ২০২০