বাংলাদেশে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোকে বিনিয়োগের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের এ অঞ্চলের তিন বিলিয়ন মানুষের বাজার পেতে বিনিয়োগ চেয়েছেন। বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) দুই দিনব্যাপী ‘কমনওয়েলথ ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফোরাম-২০২৩’-এর জমকালো উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের বাজারের কেন্দ্রস্থলে। এছাড়া, আমাদের রয়েছে ১৭ কোটি মানুষ, যার বৃহৎ অংশ যুবসমাজ।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সচ্ছল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে তিন কোটি। ফলে জার্মানি ও যুক্তরাজ্যকে পেছনে ফেলে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বাজারে পরিণত হবে বাংলাদেশ।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘এই আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ অন্যান্য কমনওয়েলথভুক্ত দেশের উন্নয়ন যাত্রায় অংশ নিতে আগ্রহী দেশ, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আমরা দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রায় ৭০ শতাংশই আসে পুনঃবিনিয়োগ থেকে। এ থেকে প্রমাণ হয় বাংলাদেশে বিনিয়োগের চমৎকার পরিবেশ বিদ্যমান।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি যে দুদিনব্যাপী এই ফোরামে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক অর্জন ও গতিশীল শিল্প খাতের সম্ভাবনাগুলো তুলে ধরা এবং প্রতিশ্রুতিশীল দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বিনিয়োগ বিকাশের লক্ষ্য আরও প্রসারিত হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি করার চেষ্টা করছি, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগ করার পরিবেশকে আরও সহজ করে তুলবে।’
‘অন্তর্ভুক্তিমূলক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের ওপর তিনি সর্বদা গুরুত্বারোপ করে থাকেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ কমনওয়েলথের বিজনেস-টু-বিজনেস (বিটুবি) কানেকটিভিটি ক্লাস্টারের লিড কান্ট্রি হিসেবে নেতৃত্ব প্রদান করছে এবং আন্ত-কমনওয়েলথ বাণিজ্য লক্ষ্যমাত্রা ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্জনে কমনওয়েলথ ও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করছে।’
এছাড়া, বাণিজ্য সহজীকরণের লক্ষ্যে কমনওয়েলথ সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে কাগজবিহীন (পেপারলেস) বাণিজ্য সুবিধা সংক্রান্ত আইনি কাঠামো প্রণয়নে সহায়তা প্রদানের জন্য ‘লিগ্যাল রিফর্ম অ্যান্ড ডিজিটাইজেশন ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠন করা যেতে পারে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের অকুণ্ঠ সমর্থন প্রয়োজন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের প্রয়োজন অধিকতর টেকসই বিনিয়োগ। বিনিয়োগ বিকাশের পূর্ব শর্ত হিসেবে আমার সরকার যে কার্যক্রমগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করেছে, তা হলো সাংগঠনিক সংস্কার, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ গঠন, বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান এবং বিনিয়োগ পরবর্তী সেবা নিশ্চিতকরণ।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য প্রায় সব খাতই উন্মুক্ত। তবে এর মধ্যে কৃষিপণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুত, চিকিৎসা উপকরণ, গাড়ি ও জাহাজ নির্মাণ, তথ্য প্রযুক্তিসহ অনেক খাতে অধিক বিনিয়োগ করা যেতে পারে।’
তিনি বলেন ‘এসব খাতে আকর্ষণীয় বিনিয়োগ সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি ব্যবসা হতে উদ্ভূত লাভ বা ডিভিডেন্ড নিজ দেশে ফেরত নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সহজতর করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের কাছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বিডা অনলাইনভিত্তিক ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করেছে। এর মাধ্যমে ২৬টি সংস্থার ৭৮টি সেবা একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে দেওয়া হচ্ছে।’
‘বিনিয়োগের পূর্ব শর্ত হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন’ উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘এজন্য আমরা সমগ্র দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ১০৯টি হাইটেক পার্ক এবং সফটওয়্যার প্রযুক্তি পার্ক এবং আইটি প্রশিক্ষণ এবং ইনকিউবিউশন সেন্টার স্থাপন করছি। যেখানে বৈদেশিক বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে।’
এ সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সড়ক, রেল এবং আকাশপথে যোগাযোগ উন্নত হচ্ছে। দেশের প্রায় সব মহাসড়ক চার বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে বা হচ্ছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা সরাসরি রাজধানী ঢাকা এবং দেশের অন্য অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। পদ্মা সেতু দিয়ে শিগগিরই ঢাকার সঙ্গে খুলনার রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে, যা মোংলা বন্দর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। পাশাপাশি চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল চালু হবে শিগগিরই।’ চট্টগ্রাম থেকে পর্যটন শহর কক্সবাজারে রেললাইন নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘ঢাকায় গত বছর মেট্রোরেলের একাংশ এবং কয়েক দিন আগে দেশের প্রথম এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ উদ্বোধন করা হয়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এসব অবকাঠামোর পুরো অংশ চালু হলে ঢাকায় গণপরিবহন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। ট্রাফিক জ্যামে আর কাউকে বসে থাকতে হবে না।’
কমনওয়েলথ এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কাউন্সিল (সিডব্লিউইআইসি), বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জেডআই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে অংশীদারিত্বে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সিডব্লিউইআইসি চেয়ারম্যান লর্ড মারল্যান্ড।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, বিডা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া এবং স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভাইজার অব কমনওয়েলথ কান্ট্রিস অ্যান্ড বিয়ন্ড জিল্লুর হোসেন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে টেকসই, পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ প্রচারের লক্ষ্যে ২০২২ সালে প্রবর্তিত দ্বিতীয় ‘কমনওয়েলথ-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু গ্রিন ইনভেস্টমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা হয়।
উগান্ডার ‘ইকো ব্রিকস’ এই পুরস্কারটি জিতে নেয়। ইকো ব্রিকসের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন।
‘অব্যাহত এবং টেকসই জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করার জন্য বাণিজ্য ও জলবায়ুর প্রভাবের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘টেকসই পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ সরকার ও কমনওয়েলথের যৌথ উদ্যোগে ২০২২ সাল থেকে প্রদান করা হচ্ছে ‘কমনওয়েলথ-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু গ্রিন ইনভেস্টমেন্ট অ্যাওয়ার্ড।’
কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে এই পুরস্কার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং মানুষকে উৎসাহিত করবে বলে আশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা।
শুরুতেই বাংলাদেশে কমনওয়েলথ ব্যবসা এবং সুযোগ নিয়ে একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়।
দুদিনব্যাপী সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা ১২টিরও বেশি সেশনে অংশ নিচ্ছেন।
কমনওয়েলথ হলো ৫৬টি দেশের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, যা সাধারণ মূল্যবোধ দ্বারা একত্রিত এবং বিশ্বের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের আবাসস্থল। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে কমনওয়েলথের ৩৪তম সদস্য হিসেবে যোগদান করে।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে আরও বলেন, ‘গত প্রায় ১৫ বছরে দারিদ্র্যের হার ৪১.৫ থেকে ১৮.৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৫৯ বছরে থেকে ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। খাদ্য ও পুষ্টির জোগান আমরা দিতে সক্ষম হয়েছি। এমনকি চিকিৎসাসেবা মানুষের দোরগোড়ায় আমরা পৌঁছে দিচ্ছি। এই সময়ে আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ মার্কিন ডলার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যদিও কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। কারণ, আমরা এই মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৫ মার্কিন ডলারে তুলতে পেরেছিলাম। তবে, আমরা আরও উন্নতি করতে পারবো, সে বিশ্বাস আমার আছে।’
‘বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হওয়ার যোগ্যতাও ২০২১ সালে অর্জন করেছে, যার বাস্তবায়ন ২০২৬ সাল থেকে শুরু হবে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘২০০৬ সালে জিডিপি’র পরিমাণ ছিল মাত্র ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে (২০২২ পর্যন্ত) তা পৌনে আট গুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এমনকি করোনা মহামারির সময় যখন বহু দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক, তখনও আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩.৫১ শতাংশ, যা আমাদের অর্থনীতির স্থিতিস্থাপকতারই প্রমাণ বহন করে।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘পাশাপাশি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমরা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। চাল, সবজি, ফল, মাছ, মাংস এবং ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা। সে লক্ষ্য অর্জনের পর আমরা কাজ করছি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের। স্মার্ট সরকার, স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি ও স্মার্ট সমাজ গড়ে তোলার মাধ্যমে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হবে।’’
দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুতের সেবা প্রদান, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং দেশের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন খণ্ডচিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি জ্ঞানভিত্তিক উন্নত স্মার্ট দেশে এবং ২১০০ সালের মধ্যে টেকসই বদ্বীপে পরিণত হওয়ার। সে লক্ষ্যে আমরা প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি।’ খবর: বাসস