বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন শনিবার
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী শনিবার (২৮ অক্টোবর) কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ উদ্বোধন করবেন।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজারের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার ও এক ঘণ্টা সময়ও কমিয়ে আনছে টানেলটি।
দুটি টিউবের চার লেনের সড়কের মাধ্যমে নদীর তলদেশ দিয়ে পাঁচ মিনিটে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে যাওয়া যাবে আনোয়ারায়।
পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে উদ্বোধনের পর আনোয়ারা প্রান্তে জনসমাবেশে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী। আর আগামী রোববার (২৯ অক্টোবর) সকাল ৬টা থেকে সর্বসাধারণের যান চলাচলের জন্য টানেলটি খুলে দেওয়া হবে।
দেশের বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামকে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ করবে প্রকল্পটি। চট্টগ্রামের নতুন শহর গড়ে উঠবে নদীর অপর প্রান্তেও। চট্টগ্রাম নগরীর অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক আকার হবে দ্বিগুণ।
সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রকল্পের অ্যালাইনমেন্ট পতেঙ্গা প্রান্তে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে কর্ণফুলী নদীর ২ কিলোমিটার ভাটিতে। ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার টানেল যুক্ত করবে কর্ণফুলী নদীর পতেঙ্গা নেভাল একাডেমি আর অপর প্রান্তের চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল)।
সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আনোয়ারা প্রান্তে ব্রিজ ভায়াডাক্টের দৈর্ঘ্য ৭২৭ মিটার। অ্যাপ্রোচ সড়কের দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার। টোল প্লাজার দৈর্ঘ্য ৭ হাজার ৬০০ বর্গমিটার। এ ছাড়া আনোয়ারা প্রান্তে সংযোগ সড়কের সঙ্গে ৭২৭ মিটার ভায়াডাক্ট (উড়াল সড়ক) রয়েছে।
টানেলে আন্ডার পাসের সংখ্যা আনোয়ারা প্রান্তে পাঁচটি ও পতেঙ্গা প্রান্তে একটি আর কালভার্টের সংখ্যা ১২টি। এ ছাড়া সার্ভিস এলাকায় ৩০টি বাংলো, একটি ভিআইপি বাংলোসহ মোটেল মেস, হেলথ সেন্টার, কনভেনশন সেন্টার, জাদুঘর, সুইমিংপুল, ব্রিজ, মসজিদ ও অভ্যন্তরীণ রাস্তা থাকবে।
সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, টানেলের দুপাশে দুটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, পুলিশের ক্যাম্প নির্মাণ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক কার্যক্রম এখনও বাকি। এ ছাড়া নিরাপত্তার জন্য স্ক্যান মেশিন বসানো হচ্ছে।
সেতু বিভাগ থেকে জানা যায়, দুই টিউব সংবলিত মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিলোমিটার। এ দুই টিউব তিনটি সংযোগ পথের (ক্রস প্যাসেজ) মাধ্যমে যুক্ত থাকবে। বিপদের সময় অন্য টিউবে গমনের জন্য এ ক্রস প্যাসেজগুলো ব্যবহার হবে। টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২.৪৫ কিলোমিটার ও ভেতরের ব্যাস ১০.৮০ মিটার।
বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য দুটি। এক. পরিবহনের কেন্দ্র হিসেবে চট্টগ্রামের সক্ষমতা বাড়ানো, যার ফলে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন হবে। দুই. চীনের সাংহাই শহরের মতো চট্টগ্রাম শহরকে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেলে গড়ে তোলা।
চীনের অন্যতম বৃহত্তম নগরী সাংহাইতে ২০০৯ সালে টানেল উদ্বোধনের পরে অপর প্রান্তে নতুন নগরী তৈরি হয়েছিল। সাংহাই নগরীর অনুন্নত অপর প্রান্ত দ্রুতই বিকশিত হয়ে নতুন শহর তৈরি হয়েছিল। তারপর থেকে সারা বিশ্বে সাংহাই নগরীর ট্রেডমার্ক হয়ে উঠে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ নামটি।
চট্টগ্রামও অনেকটা সাংহাই নগরীর মতো। বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর থাকার পরও নদীর ওপারে মাত্র এক কিলোমিটারের কম দূরত্বে থেকেও আনোয়ারা উপজেলা আধুনিক নগর ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন।
চট্টগ্রাম নগরীর জমির মূল্য বর্তমানে অর্ধকোটি ছড়িয়েছে। অথচ কর্ণফুলীর আনোয়ারা প্রান্তে তার দাম শতক প্রতি মাত্র ৫০ হাজার। তবে বঙ্গবন্ধু টানেলের কাজ শুরুর পর থেকে হু হু করে বাড়ছে জমির দাম।
আনোয়ারা উপজেলার চাতরী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইয়াছিন হিরু জানিয়েছেন, টানেল হওয়ার আগে যে জমির দাম ছিল কাঠাপ্রতি এক লাখ টাকা, সেখানে এখন জমির দাম কাঠাপ্রতি ৩০ লাখ টাকা। আরও দাম বাড়ার আশায় জমি বিক্রি করতে চাচ্ছে না কেউ।
নদীর তলদেশের এ প্রকল্পের নিরাপত্তা দিতে দুই প্রান্তে দুটি করে চারটি স্ক্যানার বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ চারটি স্ক্যানারের জন্য ব্যয় হচ্ছে ৩০০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, টানেল চালুর আগেই দুটি স্ক্যানার বসানো হয়েছে। বাকি দুটি স্ক্যানার আগামী মাসে দেশে আসবে। সেটাও দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকল্পে স্থাপন করা হবে।
সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ব্রিটেন থেকে আনা স্ক্যানারগুলো টানেলের ভেতর দিয়ে যাওয়া পণ্যবাহী ভারী গাড়িগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। ১৩ টন ওজনের প্রতিটি স্ক্যানার প্রায় ৫০ মিটার লম্বা ও প্রশস্ততা ১০ মিটার। সময় লাগবে পরিবহনপ্রতি দুই মিনিট।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা। পরে তা বেড়ে হয় ১০ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৪২ কোটি টাকা হয়।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং টানেল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম টানেল টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন। ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয় টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন।
চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ সুদে এ প্রকল্পের জন্য ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়। বাকি টাকার জোগান দেয় বাংলাদেশ সরকার। চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি টানেলটি নির্মাণ করছে।