পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা যাবে কি?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সরকার পরিবর্তনের পর অনেক অনেক ইস্যুর মধ্যে দেশ থেকে পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ টাকা ফেরত আনার কথা বেশ উচ্চারিত হচ্ছে। বিষয়টি আরো বেশি করে সামনে আসে ঢাকায় আসা উচ্চ পর্যায়ের একটি মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফরের সময়। পররাষ্ট সচিব জসীম উদ্দিন তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘পাচার করা অর্থ ফেরাতে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে এক্সপার্টিজ (দক্ষতা) আছে,সেটা হয়তো আমরা ব্যবহার করব’। তবে নিজেই আবার বলেছেন,‘এই আলাপটা কেবল শুরু হয়েছে,এর চূড়ান্ত রূপ পেতে একটু সময় লাগবে।’
অর্থাৎ একেবারেই প্রাথমিক স্তরের আলোচনা শুরু হয়েছে বলা যায়। প্রথমেই বলে রাখা দরকার যে এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ টাকা টাকা স্থানান্তরিত হয় নানা অবৈধ উপায়ে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা,সুশাসনের অভাব আর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির প্রশ্রয়ে বাংলাদেশের টাকা খুব সহজেই পাচার হয়েছে ভিনদেশে। তবে ঠিক কী পরিমাণ টাকা পাচার হয়,তার নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি গত বছর মে মাসে বিকল্প বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরার সময় বলেছিলেন যে, ৫০ বছরে দেশ থেকে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। সে হিসেবে গড় বছরে অন্তত ২৪ হাজার কোটি টাকা করে পাচার হয়েছে। আবার ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই)-র পরিসংখ্যান দেখায় যে,আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ২০০৯-২০১৫ সময়কালে মোট অন্তত ৮২৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ– সিপিডি ২০১৯ সালে বলেছিল, বাংলাদেশে যে পরিমাণ রাজস্ব আহরণ হয় তার ৩৬ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে পাচার হয়।
পুঁজি পাচারের কোনো অভিন্ন সংজ্ঞা সেভাবে নেই। বৈধ ও অবৈধ দুভাবেই পুঁজি একদেশ থেকে আরেক দেশে স্থানান্তরিত হতে পারে। মুদ্রামানের পতনজনিত কারণে অনেক সময় দেশ থেকে টাকা বাইরে চলে যায়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের মুনাফা ও পুঁজি নিজদেশে বৈধপথে প্রত্যাবাসন করে থাকে। আবার বৈধ উৎসে উপার্জিত আয় অবৈধপথে বা কর ফাঁকি দেয়া অর্থ বৈধপথে বিদেশে যেতে পারে। এ কথাও প্রচলিত আছে যে,বিদেশে বিনিয়োগ করার আড়ালেও টাকা পাচার হচ্ছে।
কিন্তু এগুলো চিহ্নিত করা কঠিন। পাচারের টাকার ফেরতের চেষ্টা করে। বিষয়টি জটিল বিধায় সফলতা কম। সারা বিশ্বের গড় হিসেবে মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ টাকা ফেরত আসে। পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা নিয়ে শেখ হাসিনার সরকারও নানা সময় উদ্যোগের কথা বলেছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বলা হয়েছিল এক বছরের জন্য বিদেশে পাচার করা টাকা ৭ শতাংশ হারে কর দিয়ে দেশে ফেরত আনার আইনি সুযোগ দেয়া হয়। তবে অর্থবছর শেষে দেখা গেল, এ সুযোগটি কেউ কাজে লাগাননি। যারা টাকা পাচার করেছেন,তারা কেনই বা বাড়তি কর দিয়ে টাকা দেশে ফিরিয়ে আনবেন এবং পাচারকারী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে নথিভুক্ত হতে যাবেন? তাই সে উদ্যোগ কাজে লাগেনি।
বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের বড় গন্তব্য ছিল যুক্তরাজ্য,দুবাই, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্য বিশ্বব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সরকার আলোচনা শুরু করেছে। পাশাপাশি দেশে ঋণ খেলাপিদের যেসব সম্পদ আছে,সেসব জব্দের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কিন্তু কাজটা সহজ নয়। বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং এর মধ্যে একটি বড় পথ। প্রায়ই শোনা যায়, আমদানির ঘোষণায় যে পণ্য দেশে আসার কথা, তা না এনে প্রকৃতপক্ষে অন্য পণ্য আনা হয়েছে। এসব ঘটনায় বিদেশি রপ্তানিকারকের তথ্যের সঠিকতা যাচাই করা বেশ কঠিন এবং অনেক সময় তা করা যায়ও না। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট বিএফআইইউ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে,ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক বা ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিতদের সঙ্গে যোগসাজশে বা জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ করে বিদেশে অর্থপাচারের অপরাধে অভিযুক্তরা অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং এসব ঘটনা তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। ওভার-ইনভয়েস ও আন্ডার-ইনভয়েসের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয় বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়। এতে আরো বলা হয়,রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন কর না থাকা এবং কিছু পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শূন্য শুল্কহার থাকায় কাস্টমস কর্মকর্তারা রপ্তানি চালান যাচাইয়ে কম মনোযোগী হন। পাচারকারীরা এই সুবিধাটিই বেশি গ্রহণ করছে।
টাকা ফেরত আনতে গেলে যেসব দেশে টাকা পাচার হয়েছে তাদের সদিচ্ছা এবং তাদের সাথে কূটনৈতিক সখ্যতা ছাড়া সম্ভব হয়না। এ ছাড়া সুস্পষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করতে হয়। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া,তথ্য যাচাইবাছাইয়ে সময় লেগে যায় অনেক।
অর্থনীতির আকার বাড়লে পাচারের সুযোগও বাড়ে। দেশে সুশাসনের ঘাটতি, আর্থিকখাতে অনিয়মকে প্রশ্রয় দেয়া এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে অনাগ্রই পাচারের সুযোগ করে দেয়। একটা কথা মনে রাখা দরকার যে যারা টাকা বাইরে পাচার করেন, তারা সাধারণত তা ফেরত নিয়ে আসার প্রত্যাশায় করেন না। তারা এমনভাবে করেন যেন ফেরত আনা না যায়। পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার প্রচেষ্টা এ কারণেই বেশ দুঃসাধ্য কাজ। এ ছাড়া প্রযুক্তির নতুন সব উদ্ভাবন টাকা পাচারকে সহজতর করে তুলেছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিটকয়েন বা ভার্চুয়াল মুদ্রার কথা তো আমরা জানিই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর্থিক পণ্যের নানা বৈচিত্র্য,যা এখন টাকা পাচারের বহুমুখী পথ খুলে দিয়েছে। তাই টাকা পাচার রোধ করা যেমন কঠিনতর হয়ে উঠেছে, তেমনি তা ফিরিয়ে আনাও কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে শক্তপোক্ত উদ্যোগ নিলে কিছু টাকা ফেরত আনা যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
লেখক: সাংবাদিক