মত-অমত

পলিথিন পরিহারে প্রয়োজন বিকল্প ব্যবহার, সচেতনতা ও আইনের প্রয়োগ

মোঃ রুপাল মিয়া   

মানুষ কোনো কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, সেটার ভালো-মন্দের বিষয় খুব সহজে অনুভব করতে চান না। এজন্য বলা হয় মানুষ অভ্যাসের দাস। কিন্তু এই দাসত্ব যদি নিজের কিংবা অন্যের জন্য ক্ষতিকর হয়, তা বরণ করা নিতান্তই বোকামি। পলিথিনের ব্যবহার এমন একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, যেটাকে মানুষ শুধু প্রয়োজনীয়তা মনে করছেন। এই পলিথিনের ব্যবহার পরিবেশের জন্য যে কতটা ভয়াবহ, তা মানুষ উপলব্ধি করতে পারছেন না। তাইতো বলা হয়- মানুষ তার ভুলটা বুঝতে পারেন, ভুলের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে।

পলিথিন অত্যন্ত পরিচিত প্লাস্টিক। এটি অস্বচ্ছ ও নমনীয়। সহজে পচনশীল না হওয়ায়, পলিথিন আমাদের বিভিন্ন কাজে লাগলেও তা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ব্যবহৃত পলিথিনের পরিত্যক্ত অংশ দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত ও অবিকৃত থেকে মাটি ও পানি দূষিত করে।

আমাদের দেশে পলিথিন ব্যবহারের প্রবণতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মূল কারণ হলো পলিথিনের সহজলভ্যতা। এক সময় মানুষ কাপড়ের বা পাটের ব্যাগ হাতে বাজারে যেতো। এর মানে এই নয় যে, সে সময় পলিথিনের ব্যবহার ছিল না। তখন পলিথিনের ব্যবহার ছিল সীমিত। বাংলাদেশে ১৯৮২ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে পলিথিনের উৎপাদন শুরু হয়। পলিথিনের অতি ব্যবহারের কারণে ১৯৯৮ সালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

বর্তমান মানুষ পলিথিনের ব্যবহারকে যতটা সুবিধাজনক মনে করে, কাপড়ের বা পাটের ব্যাগ হাতে করে বাজারে যাওয়াকে ততটাই বিরক্তিকর মনে করে। বাজারে গিয়ে কোনো কিছু কিনলেই দোকানদার বিনামূল্যে পলিথিনের ব্যাগ দেন। এমনকি যতটা পণ্য কেনা হয়, দোকানদার ততটা পলিথিনের ব্যাগ দিতেও কার্পণ্য করেন না। অনেক সময় ক্রেতার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ পণ্যভরা কয়েকটি পলিথিনের ব্যাগকে একটি বড়ো পলিথিনের ব্যাগে ভরে দেন। এমন সুবিধাকে কেউ কখনও এড়িয়ে চলতে চান না। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছি, এই পলিথিন আমাদের কতটা ক্ষতি করছে?  উত্তর: না। কারণ আমরা সব সময় বর্তমান সুবিধার কথাই চিন্তা করি। এর ভবিষ্যৎ প্রভাবের বিষয়টি মাথায় নেই না।

পলিথিন এমন একটি পদার্থ যা মাটিতে মিশে যেতে সময় লাগে ২০০ থেকে ৪০০ বছর। প্রতিদিন কোনো না কোনো কারণে বাজার থেকে নিয়ে আসা পলিথিনগুলো কোথাও না কোথাও ফেলছি। পরিত্যক্ত পলিথিনগুলো মাটির উর্বরতা বা মাটির গুণাগুণ নষ্ট করছে। ড্রেনে জমা হয়ে পয়ঃনিষ্কাশনে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। ফেলে দেওয়া পলিথিন ব্যাগের একটি বিরাট অংশ কোনো না কোনোভাবে নদ-নদীতে গিয়ে পড়ছে। এরফলে নদ-নদী দূষিত হওয়ার পাশাপাশি তলদেশে পলিথিনের স্তর তৈরি হচ্ছে। এতে নদ-নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছে। আবার পলিথিন পোড়ালে এ থেকে উৎপন্ন কার্বন মনোক্সাইড বাতাস দূষিত করছে। তাই পলিথিন ব্যবহারের সাময়িক সুবিধা থাকলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পরিবেশের উপর মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

মানুষের স্বাস্থ্যের উপর পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাবও কম নয়। গরম খাবার পলিথিনে নেওয়া হলে, প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা খাবারের সঙ্গে দ্রুত মিশে যায়। এতে স্বাস্থ্যের জন্য বড়ো ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়। পলিথিনের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে চর্মরোগ, ক্যানসারসহ আরও জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে পলিথিন ব্যাগকে চর্মরোগের এজেন্ট বলা হয়। পলিথিনে মাছ, মাংস ইত্যাদি মুড়িয়ে রাখলে কিছুক্ষণ পর এতে রেডিয়েশন তৈরি হয়। ফলে খাবার বিষাক্ত হয়ে ওঠে। পলিথিন রং করার জন্য ব্যবহৃত ক্যাডমিয়াম মানব শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে ২০০২ সালে সংশোধনী এনে পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করা হয়। এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ৬(ক) ধারাটি সংযোজন করা হয়। এই আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন, আমদানি বা বাজারজাত করেন, তাহলে অন্যূন ২ (দুই) বৎসর, অনধিক ১০ (দশ) বৎসর কারাদণ্ড বা অন্যূন ২ (দুই) লক্ষ টাকা, অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। এমন শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও পলিথিনের ব্যবহার রোধ করা সম্ভব হয়নি।

মানুষের কাছে পলিথিনের ব্যবহার হচ্ছে ফাস্ট ফুডের মতো। ফাস্ট ফুড ক্ষতিকর তা সত্ত্বেও মানুষ যেমন গ্রহণ করেন,  তেমনি পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহার করছেন। আইন দ্বারা ফাস্ট ফুড গ্রহণ রোধ সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সচেতনতাই একমাত্র উপায়। কিন্তু পলিথিনের ব্যবহার রোধে সচেতনতার পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি। তবে এটাও সত্য যে, এত প্রয়োজনীয় পণ্যটির বিকল্প উপায় বের না করে তা বন্ধ করলে জনগণ বিড়ম্বনার সম্মুখীন হবেন। আশার কথা বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মোবারক আহমদ খান পাটজাত পলিথিন (বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক) আবিষ্কার করেছেন। যা ‘সোনালি ব্যাগ’ নামে পরিচিত। পাট বাংলাদেশের একটি অর্থকরী ফসল। পাট ও পাটজাত পণ্য পচনশীল হওয়ায় তা পরিবেশবান্ধব। তাই পাটজাত পণ্যকে পলিথিনের বিকল্প হিসাবে ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে এমনটাই প্রত্যাশা।

(পিআইডি ফিচার)

 লেখক : সহকারী তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রংপুর