নবান্ন নিয়ে এলো অগ্রহায়ণ
ঢাকা জার্নাল: এল অগ্রহায়ণ। অগ্রহায়ণ নবান্নের মাস। এ মাসে নবান্ন উৎসবে মিলিত হয় কৃষক। গ্রামীণ জনপদে বইছে এখন উৎসবের আমেজ। গ্রামে যাদের শিকড় কেবল তারাই এ উৎসবের মর্মার্থ অনুধাবনে সক্ষম। নতুন ফসল ঘরে তোলার আনন্দই আলাদা। এ সময় কৃষকদের চোখে ভাসে হাসির ঝিলিক।
নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। এ যেন সত্যি হৃদয়ের বন্ধনকে আরো গাঢ় করার উৎসব। হেমন্ত এলেই দিগন্তজোড়া প্রকৃতি ছেয়ে যায় হলুদ-সবুজ রঙে। এই শোভা দেখে কৃষকের মন আনন্দে ভাসতে থাকে। কারণ, কৃষকের ঘর ভরে উঠবে গোলা ভরা ধানে। অগ্রহায়ণে অবসান হয় কৃষকের এই প্রতীক্ষার। বাড়ির আঙিনা নতুন ধানের ম-ম গন্ধে ভরে ওঠে।
কৃষকের মাঠে এখন সোনারঙা ধানের ছড়াছড়ি। সারা দেশেই আমন ধান কাটার উৎসব শুরু হয়ে গেছে। সর্বত্র ধ্বনিত হচ্ছে, ‘আজ নতুন ধানে হবে রে নবান্ন সবার ঘরে ঘরে।’ নতুন ধানের ভাত মুখে দেওয়ার আগে মিলাদ পড়ানো হয়। মসজিদে শিন্নি দেওয়ার রেওয়াজও আছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কৃষকের ঘরে পূজার আয়োজনও চলে।
বাংলাদেশ উৎসবের দেশ। বাংলাদেশে প্রচলিত উৎসবের মধ্যে নবান্ন উৎসব অন্যতম। এ সময় আমন ধান কাটা হয়। এই নতুন ধানের চাল দিয়ে রান্না উপলক্ষে নবান্ন উৎসব হয়ে থাকে। কোনো কোনো অঞ্চলে ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে নিয়ে ঘরের চালে বেঁধে রাখে এবং বাকি অংশ চাল করে নতুন চালের পায়েস করে নবান্ন করে থাকে।
নবান্ন উৎসবের অন্যতম প্রথা হচ্ছে কাকবলি। একটি কলার ডোগায় নতুন চাল, কলা, নারকেল নাড়ু কাককে খাওয়াতে হয়। প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নিয়ে ছড়া আছে। ছোট ছেলে-মেয়েরা ছড়া কেটে দাঁড় কাককে নিমন্ত্রণ করত।
ছড়াটি এরকম : ‘কো কো কো,/ আমাগো বাড়ি শুভ নবান্ন।/ শুভ নবান্ন খাবা, কাকবলি লবা,/ পাতি কাউয়া লাঠি খায়,/দাঁড় কাউয়া কলা খায়,/কো কো কো,/ মোর গো বাড়ি শুভ নবান্ন।’
কাকবলির আগে আরো তিনটি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হতো- লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ, বীরবাশ। বীরবাশের প্রথা অন্য অঞ্চলে প্রচলিত না থাকলেও বরিশালে প্রচলিত। বাড়ির উঠানের মাঝখানে একটি গর্ত করা হয়। তার চারপাশে পিটুলী দিয়ে আলপনা আঁকা হয়। গর্তে জ্যান্ত কই মাছ ও কিছু দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোতা হয়। সেই বাঁশের প্রতি কঞ্চিতে ধানের ছড়া বাঁধতে হয়। এটাকে বলা হয় বীরবাশ।
নবান্ন উৎসবে কাকবলি, লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ হয়ে গেলে সবাই একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করত। এর আগে কেউ কিছু খেত না। সবাই একসঙ্গে খেত এবং উলুধ্বনি করত। এখানেই নবান্ন উৎসব শেষ হতো না, সাধ্যানুসারে এই উৎসব উপলক্ষে প্রায় কুড়ি থেকে চল্লিশ পদের রান্না হতো। বিভিন্ন রকমের শাক রান্না করা হতো। দুপুরের নবান্ন অন্যের বাড়িতে করলেও রাতের নবান্ন সবাই নিজ বাড়িতে করত। নবান্নের পরের দিনও নবান্নের রেশ থাকত সেটাকে বলা হতো ‘বাসি নবান্ন বা বাস নবান্ন’।
নবান্ন উৎসব একটি প্রাচীন প্রথা। হিন্দুশাস্ত্রে নবান্নের উল্লেখ ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করা রয়েছে। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষ অন্ন প্রার্থনা করে থাকেন। এই কারণে হিন্দুরা পার্বণ বিধি অনুযায়ী নবান্নে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করে থাকেন। শাস্ত্রমতে, নবান্ন শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়।
অবশ্য নবান্ন উৎসব ধর্ম অনুযায়ী আলাদা আলাদা রূপ পেয়ে থাকে। মুসলমানরা নবান্ন উৎসবে অনেক কিছুই এড়িয়ে চলেন। কিন্তু তাতে উৎসবের আমেজের কোনো ঘাটতি থাকে না। পরস্পর সম্প্রীতির কোনো কমতিই দেখা যায় না। সব কৃষক প্রাণেই থাকে এক অফুরান আনন্দ বিরাজমান।
‘এসো মিলি সবে নবান্নের উৎসবে’ প্রতিবছরের মতো এবারও রাজধানীতে নবান্ন উৎসব পালিত হয়েছে। অগ্রহায়ণের প্রথম সকালে নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠে রাজধানীবাসী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় শুরু হয় নবান্ন উৎসব ১৪২১। জাতীয় নবান্ন উৎসব পর্ষদ আয়োজিত এ উৎসব সকাল ৭টার দিকে বাঁশির সুরের মধ্য দিয়ে শুরু হয়। এরপর সকাল সাড়ে ৯টায় অনুষ্ঠিত হয় নবান্ন শোভাযাত্রা। আমন ফসল ঘরে তোলাকে উপলক্ষ করে প্রতিবছর ১ অগ্রহায়ণ এ উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
এ উৎসবকে ঘিরে নানা আয়োজনের মধ্যে ছিল নৃত্য, সংগীত, আবৃত্তি, নবান্নকথন, শোভাযাত্রা, পিঠা-পায়েস, মুড়ি-মুড়কি, বাউলগান এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি।
ঢাকা জার্নাল, নভেম্বর ১৫, ২০১৪।